ইমাম আবু হানিফা রহ. কি হাদীস জানতেন না?

ইমাম আবু হানিফা রহ. কি হাদীস জানতেন না? মুফতি রেজাউল করিম! মুহাদ্দীস, সুফফাহ মাদরাসা
ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর ব্যক্তিত্ব, কৃতিত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর সমকালীন যুগ থেকে নিয়ে সর্বযুগে স্বীকৃত। মুসলিম উম্মাহর বড় বড় মনীষীগণ তাঁর অনন্য অসাধারণ এসব কৃতিত্ব ও অবদানের কথা এবং ইলমের ময়দানে তাঁর দান ও অনুদানের কথা অবলীলায় স্বীকার করে গেছেন। ইলম ও আখলাকে, জ্ঞানে ও গুণে এবং বোধ ও বুদ্ধিতে এমন বিরল প্রতিভার অধিকারী সব্যসাচী মানুষ মানব ইতিহাসে খুব কমই জন্মেছে। ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ফিকহের ময়দানের শাহেনশাহ, হাদীসের ময়দানের শাহসাওয়ার এবং অন্ধকার রাতের একজন বিনিদ্র সাধক। মুুসলিম উম্মাহ এই কিংবদন্তির কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে।
যে মানুষটির মেধা ও প্রজ্ঞায় মুসলিম উম্মাহ আলোকিত হয়েছে, যার অসাধারণ চিন্তাশক্তিতে হাজারো জটিল সমস্যার সমাধানের পথ খুলেছে, যে মানুষটি তাঁর অনন্য দক্ষতায় পবিত্র কোরআন এবং হাদীস থেকে মাসআলা বের করার পন্থা শিখিয়েছেন, যিনি হাজার হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে নির্ভরযোগ্য হাদীসের কিতাব লিখেছেন; সেই মানুষটির ব্যাপারে যখন বলা হয় তিনি হাদীস জানেন না এবং বুঝেন না তখন বিবেকের দংশন এবং আত্মার দহন নিজেকে কুরে কুরে খায়। আজ এত বছর পরে সমালোচকদের অভিযোগের কারণে যখন আমাদেরকে এই কথা লিখতে হয় যে, ইমাম আবু হানিফা (রহ.)ও হাদীস জানতেন তখন লজ্জায় নিজেকে ছোট মনে হয়। এটা কীসের সাথে কীসের তুলনা! যে মানুষটি হাদীস অন্বেষণ করার জন্য দেশ থেকে দেশান্তরে সফর করেছেন, যিনি যুগ যুগ ধরে বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে হাদীস থেকে মাসআলা ইস্তিম্বাত করেছেন; তার ব্যাপারে হাদীস না জানার অভিযোগ তোলা চরম আপত্তিকর এবং হাস্যকর। এটা একেবারেই নিচু মানসিকতার পরিচায়ক। হিংসা, বিদ্বেষ এবং পক্ষপাতদুষ্ট উদ্দেশ্য প্রণোদিত হীন মানসিকতা ছাড়া কোনোভাবেই এ ধরনের অসত্য ও অবাস্তব অভিযোগ তোলা সম্ভব নয়। আর এটাই সত্য, যারা অভিযোগ তোলেন এই কারণেই তোলেন। যদিও তাদের এই অভিযোগ অবাস্তব বিষয় নিয়ে অরণ্যে রোদন ছাড়া কিছুই নয় এবং তাদের এই অভিযোগের কারণে হানাফী মাযহাব এবং ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মতো মহীরুহের কিছুই আসে যায় না, তারপরও যেন হানাফী মাযহাব অনুসারীরা ভ্রান্তির শিকার না হন এবং হীনমন্যতায় না ভোগেন সে জন্য এখানে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর হাদীসি অবস্থান তুলে ধরার প্রয়াস চালানো হয়েছে। মহান আল্লাহই তাওফীক দাতা। ইমাম আবু হানীফা (রহ.) হাদীস অন্বেষণের ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে কতটা অগ্রগামী ও আগ্রহী ছিলেন তার প্রমাণ মেলে তারই সমকালীন সহপাঠী ইমাম মিসআর বিন কেদাম (রহ.) (১৫৫হি.)-এর কথা থেকে। তিনি বলেন,   قَالَ مِسْعَرُ بْنُ كِدَامٍ : " طَلَبنا مَعَ أَبِي حَنِيفَةَ الْحَدِيثَ ، فَغَلَبَنَا وَأَخَذْنَا فِي الزُّهْدِ ، فَبَرَعَ عَلَيْنَا وَطَلَبْنَا مَعَهُ الْفِقْهَ ، فَجَاءَ مِنْهُ مَا تَرَوْنَ " . ‘আমি আবু হানীফা (রহ.)-এর সাথে হাদীস অন্বেষণ করেছি, তিনি আমার থেকে আগে বেড়ে গেছেন। তাঁর সাথে যুহদে (আল্লাহর ইবাদত) লিপ্ত হয়েছি, সেখানেও তিনি অগ্রগামী হয়ে গেছেন। অতঃপর তাঁর সাথে ইলমে ফিকহ অন্বেষণ করেছি, এক্ষেত্রে তিনি আমার চেয়ে কত উঁচুতে উন্নীত হয়েছেন তা আপনারাই প্রত্যক্ষ করছেন। (মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা ফিল হাদীস, পৃ: ২০; মানাকেবে আবী হানীফা, পৃ: ২৭) এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, মিসআর বিন কেদাম (রহ.) (১৫৫হি.) এমন একজন হাদীস বিশারদ যার ব্যাপারে হাফেয আবু মুহাম্মাদ রামাহুরমুযী (রহ.) বলেন, কোনো হাদীস নিয়ে যখন ইমাম শো’বা (১৬০হি.) ও সুফয়ান সাওরী (রহ.)(১৬১হি.)-এর মাঝে মতানৈক্য হতো তখন তারা সে হাদীসের ব্যাপারে মিসআর বিন কেদামের সিদ্ধান্তানুযায়ী সমাধানে উপনীত হতেন। ইমাম শো’বা ও সুফয়ান সাওরী (রহ.)-কে বলা হয় ‘আমীরুল মু’মিনীন ফিল হাদীস’। তাদের মতো হাদীস বিশেষজ্ঞ যে মিসআর বিন কেদামকে সমাধানের মাধ্যম ও পাল্লা বানান, সেই মিসআর বিন কেদাম ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন যে, তিনি আমার থেকে হাদীস সংগ্রহে আগে বেড়ে গেছেন!! তাহলে হাদীসের জগতে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মর্যাদা কত ওপরে সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। (আল মুহাদ্দিসুল ফাসিল বাইনার রাবী ওয়াল ওয়াঈ, মাখতুত, হায়দারাবাদ দাক্কান; সূত্র- ইমাম ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস, মাওলানা আবদুর রশীদ নোমানী, পৃ: ১৬৬, মীর মুহাম্মাদ কুতুবখানা করাচী! ইমাম আবু হানীফা (রহ.) দেশ-দেশান্তরে সফর করে যে পরিমাণ হাদীস সংগ্রহ করেছেন তার সংখ্যাই হলো ৪০ হাজার। এই ৪০ হাজার থেকে সহীহ ও আমলযোগ্য আহকামের হাদীসগুলো বাছাই করে তিনি একটি হাদীসের কিতাব লিখেন, যার নাম কিতাবুল আছার। এ বিষয়ে সদরুল আইম্মা মুয়াফফাক বিন আহমদ (রহ.) ‘মানাকিবুল ইমামিল আযম’ গ্রন্থে লিখেছেন, انتخب ابو حنيفة رحمه الله تعالى الآثار من اربعين الف حديث. সদরুল আইম্মা মাক্কী রহঃ বলেছেন,আবূ হানীফা রহঃ চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে নির্বাচন করে 'কিতাবুল আসার' সংকলন করেছেন। (মানাকিবে ইমামে আ'যম ১/৯৫) এ ব্যাপারে অন্যত্র আবু ইয়াহইয়া যাকারিয়া বিন ইয়াহইয়া নিশাপুরী (রহ.) (২৯৮হি.) সনদসহ ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর একটি মন্তব্য উল্লেখ করেন। আবু হানীফা (রহ.) বলেন, قال يحيى بن نصر سمعت ابا حنيفة رح يقول- عندى صناديق من الحديث ما اخرجت منها الا اليسير الذى ينتقع به. (عقود الجواهر المنيفة-1/23، مناقب ابى حنيفة للموفق المكى-85) ইয়াহইয়া বিন নাসর রহৎ বলেন-আমি ইমাম আবু হানীফা রহঃ কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেন- আমার নিকট হাদীসের সিন্দুক আছে। আমি তা থেকে উপকারজনক অল্প কিছুই প্রকাশ করেছি। {উকুদুল জাওয়াহিরুল মুনীফাহ-১/২৩} الحفظ ابو نغيم الإسفحانى عن يحيى بن يصر بن حجر- دخلت على ابى حنيفة رح فى بيت مملوكتها، فقلت- ما هذه؟ قال هذه احاديث كلها، وما حدثت به الا اليسير الذى منتفغ به. (الخيرات الحسان-211 بحوالة مناقب ابى حنيفة للمرقف المكى-85) হাফেজ আবু নুয়াইম ইসফাহানী রহঃ ইয়াহইয়া বিন নাসর বিন হাজার এর সূত্রে বর্ণনা করেন-আমি কিতাবে ভরপুর একটি গৃহে ইমাম আবু হানীফা রহ এর নিকট প্রবেশ করলাম। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম এ কিতাবগুলো কিসের? উত্তরে তিনি বললেন-এ সবই হাদীসের কিতাব। এর সামান্য কিছুই আমি বর্ণনা করেছি। যার থেকে যথেষ্ট পরিমাণে উপকৃত হওয়া যায়। {আল খাইরাতুল হিসান-২১১} قال الحسن بن زياد قد انتخب ابو حنيفة “كتاب الأثار” من اربعين ألف حديث، (الخيرات الحسان-211 بحوالة مناقب ابى حنيفة للموفق-84) হাসান বিন যিয়াদ রহঃ বলেন-ইমাম আবু হানীফা রহঃ চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে “কিতাবুল আসার” নামক গ্রন্থটি সংকলন করেন। {আল খাইরাতুল হিসান-২১১} ولما حدّث الحافظ الثقة الفاضل عبد الله بن يزيد المكي أبو عبد الرحمن المقرى وكان ... عن الإمام أبي حنيفة قال: حدّثنا شاهان شاه". আব্দুর রহমান আল মুকরী যখন আবু হানিফা রহ. থেকে হাদিস বর্ণনা করতেন তখন এভাবে বলতেন - "আমার নিকট হাদীস শাস্ত্রের সম্রাট হাদীস বর্ণনা করেছেন"! আব্দুর রশীদ নুমানী দা.বা. বলেন, كتاب الآثار هو أول مصنف في الصحيح جمع فيه الإمام الأعظم صحاح السنن ومزجه باقوال الصحابة والتابعين وهو أول كتاب دوّنت فيه الأحاديث علي الترتيب الفقهي المعروف. "কিতাবুল আছার" হল, সহী প্রথম কিতাব! যাতে ইমাম আযম সহীহ হাদীসগুলো জমা করেছেন এবং সাহাবী ও তাবেয়ীনদের কওল সন্বেবেসিত করেছেন! এটাই প্রথম কিতাব যা প্রচলিত ফিকহী তারতীবে সংকলন করা হয়েছে!!! قال محمد بن سماعة: إن الإمام ذكر في تصانيفه نيفا وسبعين ألف حديث، وانتخب الآثار من اربعين الف حديث. ( هداية الساري الي دراسة البخاري ج 1 ص 264. ইমাম আবু হানিফা তার লিখনীতে সত্তর হাজারেরও অধিক হাদীস উল্লেখ করেছেন! আর চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে কিতাবুল আছার লিখেছেন! ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল কত্তান রহ. বলেন, إن أبا حنيفة -والله- لأعلم هذه الأمة بما جاء عن الله ورسوله. আল্লাহর কসম, আবু হানিফা এই উম্মতের মধ্যে কুরআন সুন্নাহ সম্পর্কে বেশী অবগত! ( আল ইমামু ইবনে মাযাহ ও কিতাবুহু আসসুনান)
সত্য প্রকাশ

আমার নামঃ মুফতি রেজাউল করিম। আমি একটি কওমী মাদরাসায় শিক্ষকতা করছি। পাশাপাশি এ ব্লগের সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। অনলাইন সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান থাকায় সময় পেলে দ্বীন ইসলাম নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করি। যেন অনলাইনেও মানুষ ইসলামি জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আপনিও চাইলে এ ব্লগে লিখতে পারেন।

Please Select Embedded Mode For Blogger Comments

নবীনতর পূর্বতন