এইচ এম রেজাউল করিম وَعِبَادُ الرَّحْمَٰنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا আর ‘রাহমান’ -এর বান্দা তারাই, যারা যমীনে অত্যন্ত বিনম্রভাবে চলাফেরা করে এবং যখন জাহেল ব্যাক্তিরা তাদেরকে (অশালীন ভাষায়) সম্বোধন করে, তখন তারা বলে, ‘সালাম’ ! ( সূরা ফুরকান63) রহমানের বান্দাদের পদ্ধতি হচ্ছে, তারা গালির জবাবে গালি এবং দোষারোপের জবাবে দোষারোপ করে না। [দেখুন-ফাতহুল কাদীর, কুরতুবী, বাদাইউত তাফসির] একবারের ঘটনা। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা. তাঁর নিকট বসে আছেন। এমন সময় এক ইহুদী এসে সালাম দেওয়ার ভান করে বলল- ‘আসসামু আলাইক।’ সালামের সঠিক শব্দ হচ্ছে ‘আসসালামু আলাইকুম’ যার অর্থ, আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আর ‘আসসামু আলাইক’ অর্থ, তোমার মরণ হোক। ইহুদী এ কাজ করলো মশকরা করার উদ্দেশ্যে, পরে এ নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করার উদ্দেশ্যে। আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রা. খুব রাগ হয়ে গেলেন এবং ঐ ইহুদিকে তিরস্কার করলেন। আর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে শুধু বললেন, ‘ওয়া আলাইক’। এরপর চুপ করে রইলেন। উম্মুল মুমিনীন যখন খুব রাগান্বিত হয়ে তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, থাম আয়েশা! কোমলতা অবলম্বন কর। -সহীহ বুখারী ২/৮৯১ (৬০৩০) এ প্রসঙ্গে অন্য হাদীসে তাঁর যে কথাটা এসেছে তা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- إِنَّ الرِّفْقَ لاَ يَكُونُ فِى شَىْءٍ إِلاَّ زَانَهُ وَلاَ يُنْزَعُ مِنْ شَىْءٍ إِلاَّ شَانَهُ কোমলতা যেখানেই থাকবে সেটাই হবে সৌন্দর্যমন্ডিত। আর যেখান থেকেই তা উঠিয়ে নেওয়া হবে, সেটাই হবে দোষযুক্ত। -সহীহ মুসলিম (২৫৯৪) আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেন, وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ وَقَالُوا لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَا نَبْتَغِي الْجَاهِلِينَ তারা যখন অবাঞ্চিত বাজে কথাবার্তা শ্রবণ করে, তখন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, আমাদের জন্যে আমাদের কাজ এবং তোমাদের জন্যে তোমাদের কাজ। তোমাদের প্রতি সালাম। আমরা অজ্ঞদের সাথে জড়িত হতে চাই না।( সূরা ক্বসাস 55) ইমাম ইবনে কাসীর ইমাম আহমাদের সূত্রে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি হলো : রাসূল (সা.) এর সামনে এক লোক আরেক লোককে গালি দিল। যাকে গালি দেয়া হলো সে গালি দেয়া লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। রাসূল (সা.) বললেন : ‘তোমাদের দু’জনের মাঝে একজন ফেরেশতা অবস্থান করছিলেন। যখনি এ লোকটি তোমাকে গালি দিচ্ছিল ফেরেশতা তোমার পক্ষ হয়ে তাকে বলছিলেন বরং এ গালি তোমারই প্রাপ্য। আর যখন তুমি তাকে বললে, তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক তখন তিনি (ফেরেশতা) বললেন, না বরং শান্তি তোমারই উপর বর্ষিত হোক। শান্তি তোমারই প্রাপ্য।’ (তাফসীরে ইবন কাসীর, খ: ৩, পৃ: ৩২৪-৩২৫) আল্লাহ আরো বলেন, وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ ( 34 ) সমান নয় ভাল ও মন্দ। জওয়াবে তাই বলুন যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবেন আপনার সাথে যে ব্যক্তির শুত্রুতা রয়েছে, সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু। ( ফুসসিলাত: 34) এরপর হাদীস শরীফে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো শিখিয়েছেন- صل من قطعك وأعط من حرمك واعف عمن ظلمك যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তুমি তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন কর। যে তোমাকে বঞ্চিত করে তুমি তাকে দান কর। আর যে তোমার উপর জুলুম করে তুমি তাকে ক্ষমা কর। (মুসনাদে আহমদ হাদীস : ১৭৪৫২) হযরত উমর ফারুক রা.-এর ঘটনা। আমরা জানি, নিয়ম নীতির বিষয়ে তিনি ছিলেন খুবই কঠোর। তাঁর মজলিশে বিভিন্ন সময়ে যাঁরা মশওয়ারার জন্য বসতেন তাদের উপাধি ছিল ‘আল কুররা’। অর্থাৎ ‘আল উলামা’। ‘কুররা’ হল ‘কারী’ এর বহুবচন। কারী বলা হয় যারা কুরআন পাঠ করে। এখানে উদ্দেশ্য, যারা কুরআনের আলেম। এই মজলিশের একজন ছিলেন হুর ইবনে কায়স। তার চাচা উয়াইনা ইবনে হিসন একবার গ্রাম থেকে এসে বলল, আমীরের কাছে তো তোমার বেশ মর্যাদা! তুমি তাঁর পরামর্শ সভার একজন সদস্য। তুমি আমার জন্যে একটু অনুমতি নাও- আমি তাঁর সাথে একটু কথা বলতে চাই। হুর ইবনে কায়স হযরত উমর ফারুক রা.-এর কাছে অনুমতি চাইলেন। হযরত উমর অনুমতি দিলেন। তখন উয়াইনা ইবনে হিসন বলল, هى يا ابن الخطاب، فوالله ما تعطينا الجزل ولا تحكم بيننا بالعدل হে খাত্তাবের বেটা! তুমি তো আমাদেরকে সম্পদ দেও না। আর তুমি আমাদের মাঝে ইনসাফের ফায়সালাও তো কর না। হযরত উমর রেগে গেলেন। রেওয়ায়েতে আছে- فغضب عمر حتى هم به অর্থাৎ তিনি তাকে পাকড়াও করার জন্য প্রস্ত্তত হয়ে গেলেন। হুর ইবনে কায়স দেখলেন যে, অবস্থা বেশি ভালো না। তিনি বললেন, আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ পাক তো বলেছেন- خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ. আপনি সহজ, উদার ও ক্ষমা পরায়ণ হোন এবং ভালো কাজের আদেশ করুন। আর মূর্খদের উপেক্ষা করুন। আমীরুল মুমিনীন! এই লোক একজন মূর্খ। সুতরাং কুরআন মাজীদের আদেশ অনুযায়ী আপনার এখন তার প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করা উচিত। রেওয়ায়েতে আছে- والله ما جاوزها عمر حين تلاها عليه وكان وقافا عند كتاب الله (তরজমা) আল্লাহর কসম! হুর এ আয়াত তেলাওয়াত করামাত্র ওমর (রা.) থেমে গেলেন। আর তাঁর স্বভাবই তো ছিল আল্লাহর কিতাবের সামনে থেমে যাওয়া।-সহীহ বুখারী, ২/৬৬৯ এই হলেন সাহাবায়ে কেরাম। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথার সামনে তাঁরা এমনই সমর্পিত হয়ে যেতেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথার এত মর্যাদা ছিল তাঁদের কাছে। ফলে যখনই তাঁদের সামনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা এসে যেত সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বলতেন, ‘আমান্না ওয়া সাল্লামনা।’ আমরা শোনলাম ও শিরোধার্য করলাম। ৩য় গুনঃ والذين يبيتون لربهم سجداً و قياماً অর্থাৎ তারা রাত্রি যাপন করে তাদের পালনকর্তার সামনে সেজদা করা অবস্থায় ও দন্ডায়মান অবস্থায়।( ফুরকান ৬৪) আল্লাহ তায়ালা বলেন, تَتَجَافَىٰ جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ ( 16 ) তাদের পার্শ্ব শয্যা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের পালনকর্তাকে ডাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ( 17 ) কেউ জানে না তার জন্যে কৃতকর্মের কি কি নয়ন-প্রীতিকর প্রতিদান লুক্কায়িত আছে।! عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ أَعْدَدْتُ لِعِبَادِيَ الصَّالِحِينَ مَا لاَ عَيْنٌ رَأَتْ وَلاَ أُذُنٌ سَمِعَتْ وَلاَ خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ " . مِصْدَاقُ ذَلِكَ فِي كِتَابِ اللَّهِ { فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ} হারুন ইবনু সাঈদ আল আয়লী (রহঃ) ... আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আমি আমার নেক বান্দাদের জন্য এমন জিনিস প্রস্তুত রেখেছি যা কোন চক্ষু কখনো দেখেনি, কোন কান কখনো শুনেনি এবং কোন হৃদয়-মন যা কখনো কল্পনাও করেনি। এসব নিয়ামত আমি সঞ্চিত রেখে দিয়েছি। আল্লাহ তোমাদেরকে যা জানিয়েছেন তা রাখ (তা-তো আছেই)। [ সহীহ মুসলিম - ৬৮৭২ ] এবাদতের জন্য রাত্রি জাগরনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারন এই যে, এ সময়টি নিদ্রা ও আরামের! এতে নামাজ ও এবাদতের জন্য দন্ডায়মান হওয়া যেমন বিশেষ কষ্টকর তেমনি এতে লোক দেখানো ও নাম যশের আশংকাও নেই। উদ্দেশ্য এই যে, তারা দিবা রাত্রি আল্লাহর এবাদতে মশগুল থাকে। দিবাভাগে শিক্ষাদান প্রচার জিহাদ ইত্যাদি কাজ করে এবং র্রাত্রিকালে আল্লাহর সামনে এবাদত করে। হযরত ওসমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন যে, ব্যক্তি এশার নামাজ জামাতের সাথে আদায় করে সে যেন অর্ধ রাত্রি এবাদতে অতিবাহিত করল এবং ফজরের নামাজও জামাতের সাথে আদায় করলে তাকে অবশিষ্ট অর্ধেক রাত্রি ও এবাদতে অতিবাহিতকারী গন্য করা হবে। (মুসলিম, আহমদ) রাসুল (সাঃ) এরশাদ করেন, নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়। কেননা এটা আেমাদের পুর্ববর্তী সব নেক বান্দার অভ্যাস ছিল এটা তোমাদেরকে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য দানকারী, মন্দকাজের কাফ্ফারা এবং গুনা থেকে নিবৃতকারী।(তিরমিজী, মাযহারী)