বাচ্চাদের শাসন করার শর‘ঈ পদ্ধতি

বাচ্চাদের শাসন করার শর‘ঈ পদ্ধতি
মুহিউসসুন্নাহ শাহ আবরারুল হক রহ.
------------------------------------

চারাগাছটিকে যেমন সার-পানি, আলো-বাতাস দিয়ে পুষ্টি যোগাতে হয়। মানব শিশুকেও তেমন আদব-কায়দা, শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে সভ্যতার উপাদান সরবরাহ করতে হয়। আগাছা তুলে না দিলে, বাড়তি ডালপালা ছেঁটে না দিলে চারাটি যেমন বৃক্ষ পরিণত হতে পারে না। তেমনি আদর-সোহাগের পাশাপাশি অনুশাসনের ছড়িটি না থাকলে মানব-শিশুটিও “মানুষ” হয়ে উঠতে পারে না। তবে সার-পানি, আর ডাল ছাঁটার কথাই বলি, কিংবা শিক্ষা-দীক্ষা আর অনুশাসনের কথাই ধরি- প্রয়োগ করতে হয় সুক্ষ্ণ কৌশলে ও সযত্ন প্রয়াসে। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে পরিচর্যাকারীকে হতে হয় একই সঙ্গে কুশলী ও সদা-সতর্ক। কারণ, চারাগছ ও শিশুর পরিচর্যা এমনই নাযুক যে, সামান্য অবজ্ঞা ও অবহেলায় এবং সামান্য অমনোযোগিতা ও অসতর্কতায় উভয়ের জীবনে নেমে আসে চরম সর্বনাশ।
অনেকে বাচ্চাদের বদ অভ্যাসের প্রেক্ষিতে রাগ বা শাসন করতে নারাজ। তাদের কথা হল, এখন কিছুই বলার দরকার নেই, বড় হলে সব এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। এটা মারাত্মক ভুল। হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহ. বলেছেন, বাচ্চাদের স্বভাব-চরিত্র যা গড়ার পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে গঠন হয়ে যায়। এর পর ভাল-মন্দ যেটাই হল তা মজবুত ও পাকাপোক্ত হতে থাকে, যা পরবর্তীতে সংশোধন করা কঠিন হয়ে পড়ে। সুতরাং বাচ্চা বুঝুক আর না বুঝুক ছোটবেলা থেকেই বুঝাতে থাকবে। এক সময় সে বুঝবে এবং উত্তম চরিত্র নিয়ে বড় হবে। (ইসলাহে খাওয়াতীন ২৫১-২৫২, তুহফাতুল উলামা-১/৪

আজকাল বাসা-বাড়িতে, স্কুল-কলেজে, এমনকি দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও (যারা শাসনের পক্ষে তাদের থেকে) বাচ্চাদের উপর শাসন নামের নির্যাতন চোখে পড়ে। সে শাসনের না আছে কোন মাত্রা, আর না আছে শাসিতের প্রতি হিতকামনা। এতে একদিকে শাসনকারী নিজেকে আল্লাহ তা‘আলার ধর-পাকড়ের সম্মুখীন করছে। অপরদিকে জুলূমের শিকার শিশু বা ছাত্র রাগে-ক্ষোভে হয়তো পড়া-লেখাই ছেড়ে দিচ্ছে বা আরো ঘোরতর অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, বাচ্চাদের শাসন করার ক্ষেত্রে শরী‘আত নির্দেশিত পন্থা ও সীমা উপেক্ষা করা। (তুহফাতুল উলামা-১/৪৯৩)

চলমান পরচায় পিতা-মাতা ও শিক্ষক কর্তৃক সন্তান ও ছাত্রদের শাসন করার সহীহ পদ্ধতি বাতলে দেয়া হচ্ছে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে বুঝার ও আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
(১) কোন শিশু বা ছাত্র তার সাথীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তা শোনামাত্রই মেজাজ বিগড়ানো যাবে না। কেননা, শরী‘আতে এক পক্ষের অভিযোগের গ্রহণযোগ্যতা নেই। কাজেই উভয় পক্ষের কথা না শুনে কোনরূপ সিদ্ধান্ত নেয়া বা একজনকে শাস্তি দেয়া যাবে না। অন্যথায় খোদ ফায়সালাকারীই জালেম সাব্যস্ত হবে। (ফাতাওয়া আলমগীরী, বৈরুত সংস্করণ-৩/৩০৯)




(২) সবার কথা শোনার পর যখন ফায়সালা করার ইচ্ছা করবে, মনের মধ্যে কোনরূপ রাগ বা গোস্বা স্থান দেয়া যাবে না। কারণ, রাগের সময় বিবেক বুদ্ধি লোপ পায়। ফলে অধিকাংশ সময়ই রাগের মাথায় ফায়সালা ভুল প্রমাণিত হয়। এ কারণেই রাগান্বিত অবস্থায় ফায়সালা দেয়া বা শাস্তি প্রদান করা শরী‘আতে নিষেধ। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং-৭১৫৮, মুসলিম শরীফ, হাদীস নং-১৭১৭, তুহফাতুল উলামা-১/৪৮৬, ৪৯৮)
সুতরাং (ক) একেবারে ঠান্ডা মাথায়। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং-৭১৫৮, তুহফাতুল উলামা-১/৪৯০)
(খ) আল্লাহ তা‘আলাকে হাজির জেনে। (সূরা তাওবা, আয়াত-১০৫)
(গ) হাশরের ময়দানে জবাবদিহিতার কথা স্মরণে রেখে। (সূরা যিলযাল, আয়াত : ৮, বুখারী শরীফ হাদীস নং-৫১৮৮)
(ঘ) স্থান-কাল পাত্র বিবেচনা করে। (ফাতওয়া শামী-৪/৬০-৬১, কিতাবুল ফিকহু আলাল মাজহাবিল আরবা‘আ-৫/৩৫২, তুহাফাতুল উলামা-১/৪৮৫) যেমন পৃথক স্বভাবের কারণে কারো দুই থাপ্পড় আবার কারো জন্য দুই ধমক
(ঙ) অপরাধীর সংশোধনের নিয়তে। (সূরা হুদ, আয়াত-৮৮)
(চ) শরী‘আতের সীমার মধ্যে থেকে। যে শাস্তি সংগত মনে হয়-নির্ধারণ করবে। (সূরা বাকারা, আয়াত-১৯০)

(৩) শরী‘আতে নাবালেগ বাচ্চাকে বেত বা লাঠি দ্বারা প্রহার করার কোনো অবকাশ নেই। প্রয়োজনে ধমকি-ধামকি দিয়ে, কান ধরে উঠ-বস করিয়ে, এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রেখে বা বিকেলে খেলা বন্ধ রেখে শাস্তি দেয়া যেতে পারে। একান্ত অপরাগতায় হাত দিয়ে প্রহার করার অনুমতি আছে (লাঠি বা বেত দিয়ে নয়)। কিন্তু কোনো ক্রমেই (ক) তার সংখ্যা যেন তিনের অধিক না হয়। (ফাতাওয়া শামী-১/৩৫২)
(খ) চেহারা ও নাযুক অঙ্গে যেমন মাথায় পেটে ইত্যাদিতে আঘাত করা হয়। (আদ দুররুল মুখতার-৪/১৩)
(গ) যখম হয়ে যায় বা কালো দাগ পড়ে যায় এমন জোরে না হয়। (ফাতাওয়া শামী-৪/৭৯) কারণ, নাবালেগ বাচ্চাকে এই অপরাধে তিনের অধিক প্রহার করা এবং (বালেগ, নাবালেগ সবার ক্ষেত্রেই) মুখমন্ডল ও নাযুক অঙ্গে আঘাত করা হারাম। আর বালেগ ছাত্রকে সংশোধনের উদ্দেশ্য তার অপরাধের ধরণ অনুযায়ী শরী‘আতের দন্ডবিধির আওতায় এনে (যা ২নং এ বর্ণিত হয়েছে) বেত ইত্যাদি দ্বারা সীমিত সংখ্যায় (সর্বোচ্চ ১০ (বুখারী শরীফ, হাদীস নং-৬৮৪৮, ৬৮৪৯, ৬৮৫০, কিতাবুল ফিকহ আলাল মাজহাবিল আরবা‘আ-৫/৩৫২)) প্রহার করা জায়িয আছে। উল্লেখ্য, বেত হতে হবে গিঁটহীন, সরল ও মাঝারী ধরনের মোটা, যা ব্যাথা পৌঁছাবে কিন্তু দাগ ফেলবে না। (ফাতাওয়া শামী-৪/১৩)

(৪) কোনো ধরনের অমানবিক শাস্তি দেয়া-যেমন, হাত-পা বেঁধে পিটানো, পিঠমোড়া করে বেঁধে রাখা, সিলিংয়ে ঝোলানো, কপালে পয়সা দিয়ে সূর্যের দিকে মুখ করে রাখা ইত্যাদি বিলকুল হারাম ও নাজায়িয। (সূরা বাকারা আয়াত: ১৯০, বুখারী শরীফ, হাদীস নং-২৪৪৭, তুহফাতুল উলামা-১/৪৯২)
(৫) ধমকি বা কড়া কথার মাধ্যমে হোক আর শরী‘আত অনুমোদিত প্রহারের মাধ্যমেই হোক- সতর্ক করার উত্তম তরীকা হল- সবার সামনে মজলিসে শাস্তি বিধান করা। যাতে অন্যদের জন্যও তা উপদেশ হয়ে যায়। (সূরা নূর, আয়াত-২)
এ ক্ষেত্রে যাকে শাস্তি দেয়া হবে, প্রথমে তাকে শাস্তি গ্রহণের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নেয়া। তাকে একথা বুঝানো যে, মানতে কষ্ট হলেও শাস্তির এই ব্যবস্থা মূলত তার কল্যাণের জন্য। এর দ্বারা শয়তান তার থেকে দূর হবে। তার দুষ্টামীর চিকিৎসা হবে। আর শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হলে এ শাস্তি দ্বারা তার পিতা-মাতা যে মহান উদ্দেশ্যে তাকে উস্তাদের হাতে সোপর্দ করেছেন- তা পূর্ণ হবে এবং শয়তানের চক্রান্ত ব্যর্থ হবে। ঠিক যেমন রোগীর কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও ডাক্তাররা তার অপারেশন করে থাকে। এতে কিন্তু রোগী অসন্তুষ্ট হয় না বরং ডাক্তারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং তাকে “ফি” ও দিয়ে থাকে।

(৬) এরপর শাস্তি প্রদানকারী পিতা-মাতা বা উস্তাদ শাস্তি প্রদানের পূর্বে নিন্মোক্ত দু‘আটি অবশ্যই পড়ে নিবেন
اللَّهُمَّ إِنِّي أَتَّخِذُ عِنْدَكَ عَهْدًا لَنْ تُخْلِفَنِيهِ فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ فَأَيُّ الْمُؤْمِنِينَ آذَيْتُهُ أَوْ شَتَمْتُهُ أَوْ لَعَنْتُهُ أَوْ جَلَدْتُهُ فَاجْعَلْهَا لَهُ زَكَاةً وَصَلَاةً وَقُرْبَةً تُقَرِّبُهُ بِهَا إِلَيْكَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ . [مسند أحمد: ١٥ / ٤٩٨ حـ:٩٨٠٢]
[অর্থ:- হে আল্লাহ, আমি তোমার তরফ থেকে অবশ্য পূরণীয় একটি ওয়াদা কামনা করছি, (ওয়াদাটা হল) আমি একজন মানুষ হিসেবে (ভুলবশত) কোন মুমিন বান্দাকে কষ্ট দিলে, গালি দিলে, বদ দু‘আ দিলে, প্রহার করলে তুমি সেটাকে তার জন্য পবিত্রতা, নেয়ামত ও নৈকট্যের ওসীলা করে দিও এবং কিয়ামতের দিন এর দ্বারা তাকে তোমার নৈকট্য দান করো। (মুসনাদে আহমদ-২/৪৪৯, হাদীস নং-৯৮১৬)]
এবং উস্তাদ মনে মনে এই খেয়াল করবে, “এই তালিবে ইলম নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেহমান। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং-২৬৫০, ২৬৫৬)
সুতরাং এ হল শাহাজাদা, আর আমি তার শাস্তি বিধানকারী জল্লাদ মাত্র। আমাকে তার সংশোধনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলেই তাকে প্রহার করছি। আল্লাহ তা‘আলার কাছে তার মর্যাদা তো আমার চেয়ে বেশী ও হতে পারে। (তারপর পূর্ব নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করবে)।
(৭) শাস্তি প্রয়োগের সময় রাগান্বিত অবস্থায় শাস্তি প্রয়োগ করবে না। তবে কৃত্রিম রাগ প্রকাশ করতে পারবে। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং-৭১৫৮, মুসলিম শরীফ, হাদীস নং-১৭১৭)
(৮) কোন বাচ্চার দ্বারা অন্য বাচ্চাকে বা এক ছাত্রের দ্বারা অপর ছাত্রকে শাস্তি দিবে না। এটা শাস্তি প্রদানের ভুল পন্থা। এতে বাচ্চাদের মধ্যে পরস্পরে দুশমনী সৃষ্টি হয়। (তুহফাতুল উলামা-১/৪৯২)৯) শাস্তি প্রদান শেষে অন্যান্য ছাত্রদের বলে দিবে, “এ ব্যাপারে এর সঙ্গে কেউ ঠাট্টা বিদ্রূপ করলে তাকেও কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। তা ছাড়া ঠাট্টা বিদ্রূপ করা অনেক বড় গুনাহ এবং পরবর্তিতে বিদ্রূপকারী নিজেও ঐ বিপদে পড়ে যায়। সুতরাং তোমরা তার জন্য এবং নিজেদের সংশোধনের জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করতে থাকবে।” (সূরা হুজুরাত, আয়াত-১১, তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং-২৫০৫)

(১০) বাচ্চাদের দায়িত্ব হল, শাস্তিদাতা পিতা-মাতা বা শিক্ষকের শুকরিয়া আদায় করা এবং তার জন্য আল্লাহর দরবারে মঙ্গলের দু‘আ করা। কারণ, তিনি কল্যাণ কামনা করেই শাস্তি দেয়ার কষ্ট বরদাশত করেছেন। সুতরাং কোন অবস্থায়ই সেই মুরুব্বীদের উপর মন খারাপ করবে না ও তার সমালোচনা করবে না। (সূরা আর রাহমান, আয়াত-৬০, তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং-১৯৫৯, ১৯৬০)
(১১) শাস্তির পরিমাণ বেশী হয়ে গেছে আশংকা করলে পরবর্তীতে শাস্তিপ্রাপ্তকে ডেকে আদর করবে এবং ২/৫ টাকা বা অন্য কিছু হাদিয়া দিয়ে অন্য কোন উপায়ে খুশি করে দিবে। যাতে উস্তাদের প্রতি তার সু ধারণা বজায় থাকে, বিতৃষ্ণা সৃষ্টি না হয় এবং আখেরাতে এর জন্য কোন দাবী না রাখে। (তুহফাতুল উলামা-১/৪৯৭)
(১২) প্রতিষ্ঠান-প্রধানের কর্তব্য, হল, সকল শিক্ষককে দুষ্ট ছাত্রদের ব্যাপারে রিপোর্ট দিতে বলবেন, কিন্তু সকলকে প্রহারের শাস্তির অনুমতি দিবেন না। কারণ, সকল শিক্ষক এ কাজের যোগ্য না। অনেকে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। সুতরাং রাগের মুহূর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম এমন দু’একজনকে এ দায়িত্ব দিবেন। যেমন অপারেশনের দায়িত্ব শুধু সার্জারী বিভাগের ডাক্তারকে দেয়া হয়। যে কোন ডাক্তার তা পারেন না। তবে ৩নং বর্ণিত হালকা শাস্তি যে কোন শিক্ষক দিতে পারেন।

সত্য প্রকাশ

My name: Mufti Rezaul Karim. I am teaching in a communal madrasah, I try to write something about Deen Islam when I have time because I have a fair amount of knowledge about online. So that people can acquire Islamic knowledge online. You can also write on this blog if you want.

Please Select Embedded Mode For Blogger Comments

নবীনতর পূর্বতন