কাবিননামার আঠার নং কলাম অনুপাতে স্ত্রী নিজের উপর তালাক পতিত করার অধিকার পায়?

কাবিননামার আঠার নং কলাম অনুপাতে স্ত্রী নিজের উপর তালাক পতিত করার অধিকার পায়?

প্রশ্ন

From: Hasan
বিষয়ঃ তালাকের ব্যাপারে ফতোয়ার আবেদন
প্রশ্নঃ
তালাক সম্পর্কে ফতোয়ার আবেদন
===================
জনাব,
আমার বিবাহ হয়েছে প্রায় ১৫ বৎসর। গত পাচ বছর যাবত আমার স্ত্রী আমার থেকে আলাদা হয়ে তার বাবার বাড়িতে থাকে। আমি সময় সময় তার কাছে যাই। আগে ঘন ঘন যাওয়া হত। এখন যাওয়াটা অনিয়মিত; কখনো সপ্তাহে, কখনো পনের দিনে আবার কখনো মাসে একবার। আমাদের দৈহিক মিলনও আনিয়মিত ভাবে হয়।

আমার বর্তমান উপার্জন খুবই কম হেতু আমি তাকে কোন ভরন-পোষন দিতে পারি না। এই নিয়ে সে আমার সাথে প্রায়ই ঝগড়া করে। যার কারনে আমাদের বনিবনা হয় না।

গত ২৬/১১/২০১৬ তারিখে তার বোন আমাকে অপমান করে। যার ফলে আমি দুঃখ-কষ্টে তাদের ঘর থেকে চলে আসি। কিন্তু নিজেদের ভুল স্বিকার করা তো দুরের কথা ঐ ঘটনার জের ধরে গত ১৮/১১/২০১৬ তারিখে আমার স্ত্রী আমাকে রাগের বশবর্তী হয়ে কাজী অফিস থেকে “মহিলা তালাকের নোটিশ” পাঠায়। যার অনুলিপি আমি নিচে তুলে ধরছিঃ

প্রতিঃ ________(নাম)____________

বিষয়ঃ ১৯৬১ ইং সনের মুসলিম পারিবারিক আইনের ৮ নং অর্ডিন্যান্সের ৭ ধারার ১ উপধারা মোতাবেক স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাকে-তফউইজের নোটিশ।

জনাব, এতদ্বারা আপনাকে জানানো যাইতেছে যে, স্থায়ী ঠিকানা ____________________________________________________________
বর্তমান ঠিকানাঃ ____________________________________________
পিতার নামঃ _______________________মাতার নামঃ ________________________
পুত্রঃ _____________________________________এর সহিত আমার বিবাহ হয়।

গত প্রায় ৫ বছর তারিখ হইতে স্বামী কর্তৃক নিকাহ নামার (১৬০১ ফরমের) ১৮ নং কলামের শর্তাদি বরখেলাপ হেতু যাহার বিবরনঃ স্বামী নিখোজ থাকিলে, স্বামী ভরন পোষনে ব্যর্থ হইলে, স্বামী পুনরায় বিবাহ করিলে, স্বামীর কারাদন্ড হইলে, স্বামী বৈবাহিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হইলে, বনিবনা না হইলে, বিবাহ প্রত্যাখ্যান, স্বামী নপুংশক (সন্তান জন্ম দানে অক্ষম), স্বামী উন্মাদ হইলে, স্বামীর নিষ্ঠুরতা (স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরন করিলে), উক্ত শর্তাবলী ভঙ্গ করার দরুন তালাকে-তফউইজে দিবার ক্ষমতা বলে আমি অপারগ ও নিরুপায় হইয়া অদ্য ২৮/১১/২০১৬ তারিখে নিজেই নিজের নফসের উপর তালাক গ্রহন করিলাম।

নিবেদক /ইতি

স্ত্রীর স্বাক্ষর ও ঠিকানা
======================== এর উপরেই শেষ ==========================
উল্লেক্ষযোগ্য অন্যান্য বিষয়সমুহঃ
===============
১।
কাবিন-নামার ১৮ নং কলামে আমার স্ত্রীকে তালাক দেয়ার অধিকার দেয়া আছে এই মর্মে আমার স্বাক্ষর করা আছে। যদিও ঐ স্বাক্ষর করার সময় আমি এই বিষয়ে (স্ত্রীকে তালাকের অধিকার দেয়া বা না দেয়া) আমার কোন জ্ঞান ছিল না। অর্থাৎ স্ত্রীকে তালাকের অধিকার দিলে কি হবে বা না দিলে কি হবে তা আমি কিছুই জানতাম না। দ্বিতীয়ত “স্ত্রীকে তালাকের অধিকার” দিয়ে যে ঐ স্বাক্ষর নেয়া হচ্ছে সে ব্যাপারেও বিয়ের দিন বা আগে পরেও আমাকে কিছু বলা হয়নি বা জানানো হয়নি। আমি নিজেও কিছু বুজতে পারি নাই। আমার বিবাহের মজলিসে ঐ ১৮ নং কলামে কি লিখা হচ্ছে তা আমাকে পড়েও শোনানো হয়নি। বিবাহের মজলিশে আমাকে বিবাহ-রেজিষ্ট্রি খাতা এগিয়ে দেয়া হয়েছে স্বাক্ষর করার জন্য এবং দেখিয়ে দেয়া হয়েছে কোথায় স্বাক্ষর করবো। কি স্বাক্ষর করেছি তা পড়ার মত সুযোগ, মানসিকতা কিছুই তখন ছিল না। আমি শুধু গদবাধা কিছু লেখা আছে যেটা আমাকে স্বাক্ষর করতেই হবে মনে করে স্বাক্ষর করেছি।

২।
তালাকের নোটিশটি আমি পোষ্টম্যানের কাছ থেকে হাতে পাই ডিসেম্বরের ৭ কি ৮ তারিখে (অর্থাৎ ৭/১২/২০১৬ বা ৮/১২/২০১৬ তারিখে)। দস্তখত দিয়ে পোষ্টম্যানের কাছ থেকে হাতে পেয়ে খোলার পর আমি জানতে পারি এটা “মহিলা তালাকের নোটিশ”। তার আগে আমি জানতাম না যে ওটা তালাকের নোটিশ। তালাকের নোটিশ দেয়ার পর ৮০ দিনের মত পার হয়ে গেছে। আগামি ২৭/০২/২০১৭ ইং তারিখে ৯০ দিন বা ৩ মাস পুর্ন হবে।

৩।
তালাকের নোটিশ পাওয়ার পর আমার স্ত্রীর সাথে ফোনে যোগাযোগ করি। তারিখটা সম্ভবত ৪/১২/২০১৬ বা ৫/১২/২০১৬ এবং তাকে বলি এভাবে মহিলারা তালাক দিতে পারে না। এভাবে দিলে সেটা ইসলাম সম্মত হয় না। তাই আমি এটা একটা ফালতু কাজ হয়েছে বলে উল্লেক্ষ করি। এবং এটার কোন মুল্য নাই বলে অগ্রাহ্য করি। এরপর থেকে ফোনে আমাদের যোগাযোগ বজায় থাকে। বেশ কয়েকবার আমার স্ত্রীর সাথে বাসার বাহিরে আমার দেখাও হয়েছে। এবং আমাদের মধ্যে মিলমিশ হয়ে গিয়েছে। তবে আমি তাদের বাসায় যাইনি বলে, কোন দৈহিক মিলন হয় নাই।

এরমধ্যে গত ১৯/০১/২০১৭ তারিখে আমার শ্বশুর পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। আল্লাহর তৌফিকে আমি বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে উনার সেবা করি।

৪।
এই ৮০ দিনের মধ্যে আমার স্ত্রীর মাসিক অনিয়মিত ছিল। অসময়ে তাহার রক্তক্ষরন শুরু হয়ে প্রায় ৫ /৬ /৭ দিন করে কয়েকদফা পড়েছে। ঔষধ খাওয়ায় তা কয়েকদফা বন্ধ হয়েছে আবার পড়েছে। যার ফলে ঠিক কতটা মাসিক হয়েছে তা নির্নয় করা সম্ভব হয়নি।

৫।
ইতিমধ্যে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন থেকে আমার এবং তাহার বরাবর (সিটি কর্পোরেশনের) সালিশে উপস্থিত জন্য দুটো চিঠি এসেছে। প্রথম উপস্থিত হবার তারিখ উল্লেখকৃত প্রথম চিঠিটা আমার হাতে পৌছার পর আমি আমার স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করলে সে জানালো সে পায়নি। সে চিঠিটা পেয়েছে প্রথম উপস্থিত হবার তারিখের দিনেই বিকালে। তারপর আমি তাকে কি করবা জিজ্ঞেস করলে সে বলল “থাক যাওয়া লাগবে না, বাদ দাও” এবং ওখানে (সিটি কর্পোরেশনের সালিশে) যাওয়ার ব্যাপারে অনিহা দেখালো।

এরপর, কয়েকদিন আগে দ্বিতীয় চিঠিটা পেলাম যেটাতে আগামীকাল (১৯/০২/২০১৭) দেখা করতে যেতে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা সিটি কর্পোরেশনে গিয়ে কথা বলে এসেছি। আমাদেরকে ১৯/০২/২০১৭ তারিখে যেতে বলা হয়েছে।

এখানে একটা জিনিষ লক্ষ্যনিয় যে প্রথম চিঠীটি আমার স্ত্রী হাতে পেয়েছে “সিটি কর্পোরেশনের সালিশে উপস্থিত হওয়ার তারিখের” আগে বা পরে (আগে বা পরে এই জন্য যে তারিখটি অস্পষ্টভাবে হাতে লেখা ছিল, ১৯/১/২০১৭ বা ২৯/১/২০১৭ যা বোঝা যাচ্ছিল না)।

প্রস্নসমুহঃ
========================================
উপরোক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিচে আমার কিছু প্রশ্ন তুলে ধরা হল।

আমি তাবলীগের মেহনতের সাথে জুড়ে আছি এবং দ্বীন-দারির উপর জীবন চালানোর চেষ্টা করি। তাই দুইজন মুফতি সাহবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। একেকজন মুফতি একেক কথা বলেন। তাই উত্তরগুলো মেহেরবানী করে দলিল উল্ল্যখ সহকারে দিলে ভালো হয়। আমি তাহাদেরকে হেয় করার জন্য এই ফতোয়া চাচ্ছিনা। ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক যেটা সত্যিকারের ফায়সালা হয় সেটা মেনে নিতে তৈরী আছি।

১। আমার পক্ষ থেকে “স্ত্রীকে তালাকের অধিকার” প্রদনের ব্যাপারেঃ
একজন মুফতি সাহেব বলেনঃ “যেহেতু কাজী সাহেবের লেখা আমি না পড়ে স্বাক্ষর করেছি, তাই ওটা কাজী সাহেবের প্রতি আমার আস্থার বহিঃপ্রকাশ আর তাই উনি যা লিখেছেন তাতে স্বাক্ষর করা মানে “স্ত্রীকে তালাকের অধিকার” দেয়া হয়ে গেল।

অপর আরেকজন মুফতি সাহেব বলেনঃ “স্ত্রীকে তালাকের অধিকার” দেয়ার বিষয়টা কাজী সাহেবকে উপস্থীত মজমায় উচ্চারন করে বলতে/পড়তে হবে। তা না হলে স্বাক্ষর করলেও ওটাতে “স্ত্রীকে তালাকের অধিকার” দেয়া হয়ে যায় না।

আমার প্রশ্ন হল, এমতাবস্থায় কোনটা সঠিক দলিল সহকারে উত্তর দিবেন কি?

২। আমাদের তালাক হয়ে গেছে কিনা?
(আমিতো “স্ত্রীর তালাকের অধিকার” সজ্ঞানে দেই নাই কিন্তু আমার বিয়ের দিন স্বাক্ষর নেয়া আছে। আমার সামনে পড়া হয়েছে কিনা আমার মনে নেই। তবে সজ্ঞানে আমি ঐ অনুমতি দেই নাই।)

৩। আমি তালাকের নোটিশ হাতে পাওয়ার পর আমি সেটা মানি নাই। এরপরও কি আমাদের তালাক হয়ে যাবে?

৪। তালাক হয়ে গেলে কি করনিয়? বিয়ে দোহরান যাবে কিনা?
(এখন তো আমার স্ত্রী আমার সাথেই থাকতে চায়। সে বলতেছে সে রাগের মাথায় ঐ তালাক দিয়েছে বা নিজ নফসের উপর নিয়েছে।)

৫। কি কি শর্ত পুরন হলে এই তালাক হয়ে যাবে?

৬। কি কি শর্ত পুরন না হলে বা কি কি কাজ সম্পাদন করে থাকলে করলে এই তালাক হবে না?

৭। ভবিষ্যত করনিয় কি? কি কি ভুল আমার হয়েছে? আল্লাহর কাছে মাফ চাবো কিভাবে?

(নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

উপরোক্ত বিবরণ অনুপাতে আপনার কর্তৃক স্ত্রী তালাকে তাফয়ীজের অধিকারপ্রাপ্ত হয়নি। তাই তার নিজের উপর পতিত করা তালাক হয়নি। আপনাদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক এখনো বহাল আছে।

আপনার সবচে’ বড় ভুল হলো, স্ত্রীর ভরণপোষণ ঠিকভাবে না দেয়া। তার ভরণপোষণ আপনার যিম্মায়। বিয়ে করার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো, স্ত্রীর ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিতে হবে। তাই তাকে শ্বশুরবাড়িতে রাখা এবং ভরণপোষণে অবহেলা করা আপনার জন্য কোনভাবেই সমীচিন নয়।

كُلُّ كِتَابٍ لَمْ يَكْتُبْهُ بِخَطِّهِ وَلَمْ يُمِلَّهُ بِنَفْسِهِ لَا يَقَعُ بِهِ الطَّلَاقُ إذَا لَمْ يُقِرَّ أَنَّهُ كِتَابُهُ كَذَا فِي الْمُحِيطِ (الفتاوى الهندية، كتاب الطلاق، الفصل السادس فى الطلاق بالكتابة-1/379، المحيط البرهانى، كتاب الطلاق، الفصل السادس فى ايقاع الطلاق بالكتاب-4/486، تاتارخانية، كتاب الطلاق، الفصل السادس فى ايقاع الطلاق بالكتاب-3/380)

أَسْكِنُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ سَكَنتُم مِّن وُجْدِكُمْ وَلَا تُضَارُّوهُنَّ لِتُضَيِّقُوا عَلَيْهِنَّ ۚ [٦٥:٦]

তোমরা তোমাদের সামর্থ অনুযায়ী যেরূপ গৃহে বাস কর, তাদেরকেও বসবাসের জন্যে সেরূপ গৃহ দাও। তাদেরকে কষ্ট দিয়ে সংকটাপন্ন করো না। [সূরা তালাক-৬]

لِيُنفِقْ ذُو سَعَةٍ مِّن سَعَتِهِ ۖ وَمَن قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللَّهُ ۚ لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا مَا آتَاهَا ۚ سَيَجْعَلُ اللَّهُ بَعْدَ عُسْرٍ يُسْرًا [٦٥:٧]

বিত্তশালী ব্যক্তি তার বিত্ত অনুযায়ী ব্যয় করবে। যে ব্যক্তি সীমিত পরিমাণে রিযিকপ্রাপ্ত, সে আল্লাহ যা দিয়েছেন, তা থেকে ব্যয় করবে। আল্লাহ যাকে যা দিয়েছেন, তদপেক্ষা বেশী ব্যয় করার আদেশ কাউকে করেন না। আল্লাহ কষ্টের পর সুখ দেবেন। [সূরা তালাক-৭]

تَقُولُ المَرْأَةُ: إِمَّا أَنْ تُطْعِمَنِي، وَإِمَّا أَنْ تُطَلِّقَنِي

স্ত্রী বলবে, হয়তো আমার খরচ দাও, নতুবা আমাকে তালাক দাও। [বুখারী, হাদীস নং-৫৩৫৫]


أَلَا وَإِنَّ حَقَّهُنَّ عَلَيْكُمْ أَنْ تُحْسِنُوا إِلَيْهِنَّ فِي كِسْوَتِهِنَّ وَطَعَامِهِنَّ

আর তোমাদের উপর তাদের অধিকার এই যে, তোমরা (যথাসম্ভব) তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ ও আহারের সুব্যবস্থা করবে। [সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-৩০৮৭]

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা
সত্য প্রকাশ

আমার নামঃ মুফতি রেজাউল করিম। আমি একটি কওমী মাদরাসায় শিক্ষকতা করছি। পাশাপাশি এ ব্লগের সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। অনলাইন সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান থাকায় সময় পেলে দ্বীন ইসলাম নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করি। যেন অনলাইনেও মানুষ ইসলামি জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আপনিও চাইলে এ ব্লগে লিখতে পারেন। মোবাইলঃ 01782-40 91 69

Please Select Embedded Mode For Blogger Comments

নবীনতর পূর্বতন