কুরবানির মাসয়ালা

প্রশ্ন: কুরবানির গোস্ত বন্টনের বিধান কি? দলীল প্রমান সহ জানতে চাই!

উত্তর: কুরবানি যেহেতু একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা হয়, সে হিসেবে এর গোশত কারও জন্যই খাওয়া জায়েয হওয়ার কথা ছিল না, কিংবা আর সকলের জন্য খাওয়া জায়েয হলেও কুরবানীদাতার জন্য খাওয়ার অনুমতি থাকার কথা নয়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা বড়ই মেহেরবান। তিনি এটা সকলের জন্যই খাওয়া বৈধ করে দিয়েছেন।
 তিনি ইরশাদ করেন-

فَكُلُوْا مِنْهَا وَاَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَ الْمُعْتَرَّ، كَذٰلِكَ سَخَّرْنٰهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ

- তখন তার গোশত থেকে নিজেরাও খাও এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও এবং তাকেও, যে নিজ অভাব প্রকাশ করে। এভাবেই আমি এসব পশুকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।   সূরা হজ্ব (২২) : ১৩৬)                            

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে ইরশাদ করেছেন-

كُلُوْا وَادّخِرُوْا وَتَصَدّقُوْا

- তোমরা খাও, জমা করে রাখ এবং দান-খয়রাত কর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৬৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭২

প্রশ্ন: কুরবানির মাংস তিন ভাগ করা জরুরী কি না?

উত্তর: না, এটি জরুরী নয়। আর কুরবানীর গোস্তও তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের, এক ভাগ আত্মীয় ও এক ভাগ গরীবকে দেয়া বাধ্যতামূলক নয়। বরং মুস্তাহাব।

وَالْأَفْضَلُ أَنْ يَتَصَدَّقَ بِالثُّلُثِ وَيَتَّخِذَ الثُّلُثَ ضِيَافَةً لِأَقْرِبَائِهِ وَأَصْدِقَائِهِ وَيَدَّخِرَ الثُّلُثَ؛ وَيُسْتَحَبُّ أَنْ يَأْكُلَ مِنْهَا، وَلَوْ حَبَسَ الْكُلَّ لِنَفْسِهِ جَازَ لِأَنَّ الْقُرْبَةَ فِي الْإِرَاقَةِ وَالتَّصَدُّقِ بِاللَّحْمِ تَطَوُّعٌ

(رد المحتار، كتاب الاضحية-9/474، زكريا، بدائع الصنائع-4/2244، زكريا، الفتاوى السراجية-389

প্রশ্ন:  কুরবানীর পশুর বয়স জানেত চাই!

উত্তর: কুরবানীর পশু উটের ক্ষেত্রে ৫ বছর বয়সী, গরু বা মহিষের ক্ষেত্রে ২ বছর বয়সী হতে হবে। ভেড়া, দুম্বা বা ছাগলের ক্ষেত্রে অন্তত ১ বছর বয়সী হতে হবে, তবে ছ’মাস বয়সী হৃষ্টপুষ্ট ভেড়া বা দুম্বা হলেও চলবে। কিন্তু ছাগলের ক্ষেত্র যতই হৃষ্টপুষ্ট হোক না কেন এক বছরের কম হলে হবে না!

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন

قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: لَا تَذْبَحُوا إِلّا مُسِنّةً، إِلّا أَنْ يَعْسُرَ عَلَيْكُمْ، فَتَذْبَحُوا جَذَعَةً مِنَ الضّأْنِ

- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা কুরবানীতে ‘মুছিন্না’ ছাড়া যবেহ করবে না। তবে সংকটের অবস্থায় ছ’মাস বয়সী ভেড়া-দুম্বা যবেহ করতে পারবে। (মুছিন্না হল, ৫ বছর বয়সী উট, ২ বছরের গরু, মহিষ এবং ১ বছর বয়সী ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা ।
সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯৭

প্রশ্ন: কুরবানির পশু জবাই করার সময় কী বলতে হয়?

উত্তর: জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন দুটি দুম্বা জবাই করেছেন। যখন সেগুলোকে কেবলামুখী করে শোয়ালেন, তখন বললেন-

إِنِّي وَجّهْتُ وَجْهِيَ لِلّذِي فَطَرَ السّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ، إِنّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ، لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوّلُ الْمُسْلِمِينَ، بِسْمِ اللهِ اللهُ أَكْبَرُ، اللّهُمّ مِنْكَ وَلَكَ مِنْ مُحَمّدٍ وَأُمّتِهِ

এরপর যবেহ করেছেন। -সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ২৮৯৯

প্রশ্ন: কুরবানীর পশুর চামড়া নিজের জন্য বিক্রি করা যাবে কি না?

উত্তর: আবূ হুরায়রা রা. বলেন-

قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ : مَنْ بَاعَ جِلْدَ أُضْحِيّتِهِ فَلاَ أُضْحِيّةَ لَهُ

- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে তার কুরবানীর চামড়া (নিজের জন্য) বিক্রি করবে, তার কুরবানী শুদ্ধ হবে না। মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৩৪৬৮

উল্লেখ্য, কুরবানীর চামড়ার মূল্য সদকা করার নিয়তে তা বিক্রি করতে কোনো অসুবিধা নেই।

প্রশ্ন: কুরবানীর পশুর গোশত-চামড়া পারিশ্রমিক হিসেবে কসাইকে দেওয়া যাবে কি না?

উত্তর: আলী ইবনে আবী তালিব রা. বলেন-

أَمَرَنِي رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَنْ أَقُومَ عَلَى بُدْنِهِ، وَأَنْ أَتَصَدّقَ بِلَحْمِهَا وَجُلُودِهَا وَأَجِلّتِهَا، وَأَنْ لاَ أُعْطِيَ الْجَزّارَ مِنْهَا، قَالَ: نَحْنُ نُعْطِيهِ مِنْ عِنْدِنَا

- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তার (কুরবানীর উটের) আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করতে বলেছিলেন। তিনি কুরবানীর পশুর গোশত, চামড়া, আচ্ছাদনের কাপড় ছদকা করতে আদেশ করেন এবং এর কোনো অংশ কসাইকে দিতে নিষেধ করেন। তিনি বলেছেন, আমি তাকে (তার পারিশ্রমিক) নিজের পক্ষ থেকে দিব।
-সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩১৭; সহীহ বুখারী, হাদীস ১৭১৬

মৃত ব্যক্তির কাযা নামাযের কাফ্ফারা সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন প্রশ্ন: কুরবানী ওয়াজিব এমন ব্যক্তি কাজ সমাধা হলে কুরবানী করবে বলে মান্নত করলে বিধান কি?

উত্তর: “কুরবানী দিবো” বলার দ্বারা লোকটির উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্যের উপর নির্ভরশীল হুকুম।

দু’টি উদ্দেশ্য হতে পারে। যথা-

১-নজরে জবাহ। তথা জবাই করার নজর তথা মান্নত। যদ্বারা মাকসাদ হল, কাজটি সফল হলে, একটি পশু জবাই করে গরীবদের খাওয়াবে। এই পশু জবাইয়ের কোন সময় নির্ধারিত নেই। যেকোন সময়ই করতে পারবে। তা কুরবানীর দিনও করতে পারবে।

২-নজরে উজহিয়্যাহ। তথা কুরবানীর মান্নত। যার দ্বারা উদ্দেশ্য ছিল, তার উপর যে কুরবানী করা আবশ্যক, সেই কুরবানীটি সে আদায় করবে। আর তা আদায়ের নির্ধারিত সময় হল, জিলহজ্ব মাসের দশ, এগার ও বার তারিখ।

এ দু’টি বিষয়ের কোন একটির নিয়তে উক্ত মান্নতটি করা হয়েছে। যার নিয়ত করা হয়েছে, হুকুম সেই অনুপাতে হবে।

যদি ১ম প্রকার মান্নত করে থাকে,তাহলে এর দ্বারা ব্যক্তির উপর আবশ্যক হওয়া কুরবানীর দায়িত্ব মুক্ত হবে না। বরং আলাদা আরেকটি পশু দিয়ে আলাদা কুরবানী দিতে হবে।

আর মান্নত হিসেবে কুরবানীর পশুর গোস্ত নিজে খেতে পারবে না। কোন ধনীকেও দিতে পারবে না। বরং তা গরীবদের মাঝে দান করে দেয়া আবশ্যক।

আর যদি দ্বিতীয় প্রকার মান্নত করে থাকে, তাহলে তা মূলত তার উপর আবশ্যক হওয়া কুরবানীটি করার একটি ওয়াদা হিসেবে সাব্যস্ত হবে। তাই এর মাধ্যমে, তার উপর ওয়াজিব কুরবানী আদায় হবে। এর গোস্ত নিজেও খেতে পারবে। ধনী গরীব সবাইকে দিতে পারবে। [ফাতাওয়া কাসিমীয়া-১৭/৮২-৮৩]

إن الدماء أنواع ثلاثة: نوع يجوز لصاحبه أن ياكل منه بالإجماع ونو لا يجوز له أن ياكل منه بالإجماع ونوع اختلف فيه، فالأول: دم الأضحية نفلا كان أو واجبا منذورا كان أو واجبا مبتدأ، والثانى دم الإحصار وجزاء الصيد…….. دم النذر بالذبح، والثالث: دم المتعة القران فعندنا يؤكل وعند الشافعى رحمه الله لا يؤكل، (بدائع الصنائع، كتاب الاضحية، باب يستحب فى الأضحية أن تكون سمينة-4/223-224، بذل المجهود، قديم-4/76، جديد-9/566-567)

وإن نذر أضحية فى ذمته ثم ذبحها فله أن ياكل منها وقال القاضى من أصحابنا من منع الأكل منها وهو ظاهر كلام أحمد بناء على الهدى المنذور، (المغنى لابن قدامة-9/362


প্রশ্ন: কোরবানির চামড়ার টাকা গরিব দের না মাদরাছায় দেওয়া উত্তম?

উত্তর: মূলত কুরবানীর  চামড়া ইচ্ছে করলে নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। তবে যদি বিক্রি করে দেয়, তাহলে সেটি গরীবদের মাঝে দান করে দেয়া আবশ্যক। চামড়া বিক্রি করা টাকা নিজে রাখা জায়েজ নয়।

আবার হুবহু চামড়াও দান করে দেয়া যায়। এক্ষেত্রে হুকুম হল গরীবদের দান করে দেয়া। এটিই মৌলিক বিধান। এটি সাধারণ গরীবদেরও দেয়া যায়, আবার মাদরাসার গরীব ছাত্রদের জন্যও দান করা যায়।

যেসব মাদরাসায় গরীব ছাত্ররা পড়াশোনা করে থাকে, সেসব মাদরাসায় কুরবানীর চামড়া দেয়া উত্তম। কারণ এতে করে দু’টি সওয়াব হবে ইনশাআল্লাহ।

একটি হল, দান করার সওয়াব। দ্বিতীয় হল দ্বীনে ইলম শিখায় সহযোগিতা করা হচ্ছে। তাই যেসম মাদরাসায় এতিম বা লিল্লাহ ফান্ড রয়েছে সেসব মাদরাসার গুরাবা ফান্ডে চামড়া দান করা উত্তম। তবে এর মানে এই নয় যে, শুধু মাদরাসায়ই দিতে হবে। বরং যেকোন গরীবদের দান করলেই দানটি আদায় হয়ে যাবে।

(وَيَتَصَدَّقُ بِجِلْدِهَا أَوْ يَعْمَلُ مِنْهُ نَحْوَ غِرْبَالٍ وَجِرَابٍ) وَقِرْبَةٍ وَسُفْرَةٍ وَدَلْوٍ (أَوْ يُبَدِّلَهُ بِمَا يَنْتَفِعُ بِهِ بَاقِيًا) كَمَا مَرَّ (لَا بِمُسْتَهْلَكٍ كَخَلٍّ وَلَحْمٍ وَنَحْوِهِ) كَدَرَاهِمَ (فَإِنْ) (بِيعَ اللَّحْمُ أَوْ الْجِلْدُ بِهِ) أَيْ بِمُسْتَهْلَكٍ (أَوْ بِدَرَاهِمَ) (تَصَدَّقَ بِثَمَنِهِ)
 (رد المحتار، كتاب الأضحية--6/328)
ফরয নামাযের পর সম্মিলিত মুনাজাত জায়েয আছে কি না? জানতে এখানে ক্লিক করুন
সত্য প্রকাশ

আমার নামঃ মুফতি রেজাউল করিম। আমি একটি কওমী মাদরাসায় শিক্ষকতা করছি। পাশাপাশি এ ব্লগের সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। অনলাইন সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান থাকায় সময় পেলে দ্বীন ইসলাম নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করি। যেন অনলাইনেও মানুষ ইসলামি জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আপনিও চাইলে এ ব্লগে লিখতে পারেন। মোবাইলঃ 01782-40 91 69

Please Select Embedded Mode For Blogger Comments

নবীনতর পূর্বতন