করোনা: মসজিদে নামায বন্ধ রাখার শরয়ী বিধান |
করোনা: মসজিদে নামায বন্ধ রাখার শরয়ী বিধান
নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া যাবে না
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَة
অর্থাৎ “এবং তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।”
(সূরা বাকারা: ১৯৫)
তিনি আরও বলেন:
وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا
অর্থাৎ “এবং নিজেদেরকে হত্যা করিও না। নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি দয়াশীল।”
(সূরা নিসা: ২৯)
এ দুটি আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, জীবন নাশের কারণগুলো থেকে বেঁচে থাকা ওয়াজিব, অবশ্য কর্তব্য।
মহামারি বিস্তৃতি লাভের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের অপরিহার্যতা
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্নোক্ত হাদিসগুলো দ্বারা মহামারি বিস্তৃতি লাভের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়। যেমন:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لا يُورِد ممرض على مصح
অর্থাৎ “কোন ব্যক্তি যেন তার অসুস্থ উটকে সুস্থ উটের কাছে না নিয়ে যায়।” (বুখারি ও মুসলিম)
তিনি আরও বলেছেন,
فر من المجذوم كما تفر من الأسد
অর্থাৎ “কুষ্ঠরোগী থেকে সেভাবে পালাও যেভাবে সিংহ থেকে পলায়ন করো।” (সহিহ বুখারী)।
তিনি আরও বলেন:
إذا سمعتم الطاعون بأرض فلا تدخلوها وإذا وقع بأرض وأنتم فيها فلا تخرجوا منها
অর্থাৎ“যদি কোন এলাকায় মহামারীর কথা শুনো তবে সেখানে যেও না। আর যদি কোন এলাকায় তোমাদের থাকা অবস্থায় মহামারী সৃষ্টি হয় তাহলে সেখান থেকে বের হয়ো না।” (বুখারি ও মুসলিম)
শরীয়তের দুটি মূলনীতি
আর শরিয়তের একটি সুসাব্যস্ত মূলনীতি হল,
لا ضرر ولا ضرار
অর্থাৎ"নিজের অথবা অন্যের কোনও ক্ষতি করা যাবে না।"
শরিয়তের আরেকটি মূলনীতি হল,
أن الضرر يدفع قدر الإمكان
অর্থাৎ"যতটা সম্ভব ক্ষয়-ক্ষতি প্রতিহত করতে হবে।”
ঘরে নামায আদায়ের অনুমতি
রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে বাহনে, প্রচন্ড বৃষ্টি ও তিব্র ঠান্ডার সময় ঘরে নামায আদায়ের অনুমতি দিয়েছেন। প্রবল বৃষ্টির দিনে রঈসুল মুফাসসিরীন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. তার মুআযযিনকে নির্দেশ দিয়েছেন-
حي على الصلاة
এর পরিবর্তে صلوا في بيوتكم অর্থাৎ তোমরা মসজিদে না এসে ঘরে নামায আদায় করে নাও।
একালের ন্যায় সেকালেও কিছু মানুষ ইবনে আব্বাস রা. এর এই আদেশ শুনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো। তখন ইবনে আব্বাস রা. তাদের বলেছিলেন, আমার চেয়ে যিনি সেরা অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এর অনুমতি দিয়েছেন।
(সহীহ বুখারী)
উপরোক্ত আলোচনার উপর ভিত্তি করে বলা যায়, (বিশেষ প্রয়োজনে) মসজিদে সকল ফরয এবং জুমাআর নামায বন্ধ করা শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ। কেবল আযান দেওয়াই যথেষ্ট।
জুমার দিন বাড়িতেই যোহরের চার রাকআত সালাত আদায় করতে হবে।
ওযরের কারণে পূর্ণ সওয়াব দান করা হয়
আল্লাহর একটি অনুগ্রহ যে, ওযরের কারণে কেউ যদি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ও জুমার সালাত জামাতে আদায় করতে সক্ষম না হয় তবুও তাঁকে তার পূর্ণ সওয়াব দান করা হবে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
إذا مرض العبد أو سافر كتب له مثل ما كان يعمل مقيماً صحيحاً
অর্থাৎ "বান্দা যদি অসুস্থ হয় অথবা সফরে যায় তাহলে সে সুস্থ ও আবাস অবস্থায় যে আমল করত মহান আল্লাহ তাকে তার সমপরিমাণ সওয়াব দান করেন।” (সহীহ বুখারী)
[সম্পাদক]
দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া
গত সোমবার দেওবন্দের পক্ষ থেকে জারি করা এক আহ্বানপত্র ও ফতোয়ায় দেশের মুসলিমদের প্রতি এক নির্দেশনায় বলা হয়, করোনা ভাইরাস থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে সরকার যে কারফিউ বা লকডাউন জারি করেছে সেগুলো মেনে চলে দেশকে এ মহামারী থেকে বাঁচাতে সহযোগিতা করা আমাদের কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে নিজেরাও সতর্ক থাকবেন ও অন্যদেরও সতর্ক থাকতে বলবেন।
দেওবন্দের এ ফতোয়ায় এ কঠিন পরিস্থিতিতে মসজিদে নামাজ আদায়ের বিষয়ে বলা হয়, সরকার যেসব এলাকায় কারফিউ বা লকডাউন জারি করেছে, অথবা যেসব এলাকায় ভিড় জমায়েত থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, সেসব এলাকার মসজিদগুলোকে বন্ধ না করে মসজিদ কর্তৃপক্ষের উচিত কোনো একটি পন্থা বের করা। যেনো মসজিদকেও আবাদ রাখা যায়, আবার দেশের আইনও লঙ্ঘণ না হয়।
এটা এভাবে করা যায়, যেসব এলাকায় লোকসমাগমে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেসব এলকার মসজিদগুলোতে ইমাম মুয়াজ্জিনসহ আরো কয়েকজন মুসল্লি মিলে আজান ইকামতের সঙ্গে জামাত চালু রাখবে। আর অন্যান্য মুসল্লিগণ তাদের ঘরে নামাজ আদায় করবেন।
আর যেসব এলাকায় এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা নেই, সেখানে মুসল্লিগণ নামাজের সুন্নাত তাদের ঘরে সেরে আসবে, মসজিতে নিরাপদ দূরত্বে বসবে। জামাতে নামাজ আদায় করে আবারো ঘরে চলে যাবে। আর মসজিদ কর্তৃপক্ষের উচিত, তারা মসজিদকে পরিস্কার পরিছন্ন রাখবে।
দারুল উলুম দেওবন্দের এ ফতোয়ার পর করোনা ভাইরাস বিষয়ে মুসলিমদের আকিদা বা বিশ্বাস সম্পর্কে বলা হয়, করোনা ভাইরাস বিষয়ে প্রত্যেক মুসলিমের এ বিশ্বাস থাকতে হবে, কোনো রোগ ভাইরাস, মহামারী আল্লাহর হুকম ছাড়া কাউকে আক্রান্ত করে না। এসব রোগ ও মহামারী মানুষের গুনাহের কারণেই এসে থাকে। এগুলো থেকে আল্লাহ তায়ালাই মুক্তি দিতে পারেন।
এজন্য প্রত্যেক মুসলিমের উচিত, প্রত্যেকে নিজ নিজ দীনি অবস্থান কে শক্তিশালী করবে। অর্থাৎ গুনাহ পরিত্যাগ করা, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া, জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় না ছাড়া। তাওবা ইস্তিগফার বেশি বেশি করা। আল্লাহর কাছে গুনাহগুলোর জন্য ক্ষমা চাওয়া। সব ধরণের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। বেশি বেশি আমল করা। মানুষকে আমল ও তওবার প্রতি আহ্বান করা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দান করুন।
বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ফতোয়া
"করোনা ভাইরাস সংক্রমন রোধে এবং মানুষের ব্যাপক মৃত্যুঝুকি থেকে সুরক্ষার আকস্মিক পদক্ষেব হিসেবে সর্বপ্রকার জমায়েত বন্ধের পাশাপাশি মসজিদসমূহে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে সম্মানিত মুসল্লিগণের উপস্থিতি সীমিত ও ক্ষুদ্র পরিসরে রাখা যেতে পারে৷ মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ সুরক্ষা পদ্ধতি অবলম্বন পূর্বক মসজিদে আযান ও জামাত যথা সম্ভব বজায় রাখবেন৷ মসজিদ বন্ধ থাকবে না তবে সর্বসাধারন নিজ নিজ গৃহে অবস্থান পূর্বক সুরক্ষা পদ্ধতি অবলম্বন পূর্বক জামাত বদ্ধ হয়ে নামায আদায় করে নিবেন৷ সবাই ব্যক্তিগত ভাবে তাওবা, ইস্তেগফার অব্যাহত রাখবেন৷ মহান আল্লাহর ক্ষমা দয়া ও করুণা প্রার্থনা করে দোয়া করুন ৷ মহান আল্লাহ দ্রুত আমাদের মুক্তির দুয়ার উম্মুক্ত করুন৷ আমীন৷"