মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে আয়োজিত একটি তুলনামূলকভাবে নতুন বর্ষবরণ উৎসব। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে এটি প্রবর্তিত হয়। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসাবে সারাদেশে এটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ বরণের নামে বিভিন্ন জীব-জন্তুর মূর্তি নিয়ে মঙ্গল শোভা যাত্রা করা, মুখে উল্কি আঁকা এবং নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণসহ সকল অনৈসলামিকতা ও বিজাতীয় সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকা মুসলিমদের একান্ত কর্তব্য।
মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্ম
পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়, তার ইতিহাস মাত্র ২৭ বছর। ১৯৮৯ সালের আগে এরকম কিছু হতো না। ’আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান চালু করে চারুকলার কিছু ছাত্র। এর অন্যতম সংগঠক ছিলো শিল্পী তরুণ ঘোষ। পশ্চিম বাংলার বরোদায় আর্ট ইনিইটউটের ছাত্র ছিল সে। বরোদায় যেভাবে নতুন বছরকে বরণ করার জন্য নানা ফোক মোটিফ, মুখোশ ও খেলনার আয়োজন করে, সেই কনসেপ্ট আদমানী করে তরুণ ঘোষ এবার সাজায়। প্রথমে এর নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। সেবার কিছু মুখোশ আর জীবজন্তুর প্রতীক ছিলো। পরে এটাকে আরো হিন্দুয়ানী করে নাম বদলে দেয়া হলো ”মঙ্গল শোভাযাত্রা।” এখন সেখানে হিন্দুদের প্রায় দেবদেবী, গনেশের বিভিন্ন প্রতিমা, রাক্ষস-খোক্কস, অসুর, আবার রাজাকার প্রতিকৃতি/মুখোশ বহন করা হয়। তাহলে, এই মঙ্গল শোভাযাত্রা কি করে আবহমানকালের ঐহিত্য হয়? আসলে শেয়াল-কুকুর আর ভুত-পেত্নীর মুখোশ পরে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলার এই ব্যর্থ চেষ্টা মিথ্যাচার ছাড়া কিছুই নয়।
সর্বজনীন নয়; হিন্দুজনীন
ওরা বলছে, পহেলা বৈশাখ একটি সর্বজনিন বাঙালী উৎসব। ঐ দিনের সর্বজনীন উৎসবের মধ্যে রয়েছে: হিন্দুদের ঘটপুজা, গণেশ পুজা, সিদ্ধেশ্বরী পুজা, হিন্দুদের ঘোড়ামেলা, হিন্দুদের চৈত্রসংক্রান্তি পুজা-অর্চনা, হিন্দুদের চড়ক বা নীল পুজা বা শিবের উপাসনা ও সংশ্লিষ্ট মেলা, গম্ভীরা পুজা, কুমীরের পুজা, অগ্নিনৃত্য, ত্রিপুরাদের বৈশুখ মারমাদের সাংগ্রাই ও পানি উৎসব, চাকমাদের বিজু উৎসব (ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমাদের পুজা উৎসবগুলোর সম্মিলিত নাম বৈসাবি), হিন্দু ও বৌদ্ধদের উল্কিপুজা, মজুসি তথা অগ্নি পূজকদের নওরোজ, হিন্দুদের বউমেলা, মঙ্গলযাত্রা এবং সুর্যপুজা।
একটু ভাবুন, ইসলাম সূর্যপুজারীদের সাথে সময়ের সামঞ্জস্য হয়ে যাবে বলে তিন সময় নামায পড়া হারাম করেছে। আর কাফেরদের পুজাকে এখন বানানো হচ্ছে সর্বজনীন!!!
বর্ষবরণের নামে মূলত ভিনদেশী হিন্দুত্ববাদি ও আগ্রাসী মনুবাদ সাংস্কৃতির প্রসার ঘটানোর চেষ্টা চলছে। নতুন বছরের প্রথম দিন বাঘ, ভাল্লুক, সাপ, কুমির, পেঁচা, ময়ূর ও বিভিন্ন দেব-দেবীর বড় বড় মূর্তি, ছবি নিয়ে ও মুখোশ পরে মঙ্গল শোভা যাত্রার নামে যে র্যালি বের করা হয়, এখানে কার কাছে নতুন বছরের মঙ্গল ও কল্যাণ কামনা করা হচ্ছে? ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী কোন জীব-জন্তু, বন্যপ্রাণী ও দেব-দেবীর মূর্তির কাছে কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা করলে ঈমান থাকবে না।
আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “আর আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুকে আহ্বান করো না, যা তোমার উপকার করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না। বস্তুতঃ তুমি যদি এমন কাজ কর, তাহলে তুমি অবশ্যই জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে”। [সূরা ইউনুস, আয়াত ১০৬]
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেনঃ “তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে, যে আল্লাহ ব্যতীত এমন কাউকে ডাকে, যে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিবে না এবং তারা তাদের আহবান সম্বন্ধেও অনবহিত”। [সূরা আহকাফ, আয়াত ৫]
অতএব, অমুসলিমদের উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া এবং তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার কোন সুযোগ কুরআন অনুসারী কোন মুসলমানের জন্য নেই। তাদের উৎসব-অনুষ্ঠানের সাথে একমত পোষণ করার অর্থ কুফরের সাথে একমত পোষণ করা। আর এসবের একাংশের সাথে একমত পোষণ করার অর্থ কুফরের শাখাবিশেষের সাথে একমত হওয়া। উৎসব-অনুষ্ঠানাদি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। উৎসব দ্বারা ধর্মগুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। নিঃসন্দেহে তাদের সাথে এসব অনুষ্ঠান পালনে যোগ দেয়া একজন মুসলমানকে কুফরের দিকে নিয়ে যেতে পারে। রাসূল (স.) বলেন: مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ “য ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাথে সামঞ্জস্য রাখল সে তাদের অন্তর্ভুক্ত”। (আবু দাউদ, হাদীস নং: ৪০৩১)।
এ প্রসঙ্গে ইব্ন তাইমিয়াহ (র.) বলেন:
“وهــــذا الحديث أقل أحواله أن يقتضي تحريم التشبه بهم وإن كان ظــاهره يقتضي كفر المتشبه بهم كما في قوله تعالى: {وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ
“এ হাদিসের সর্বনিম্ন দাবি তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা হারাম, যদিও হাদিসের বাহ্যিক অর্থের দাবি কুফরি। যেমন আল্লাহ র বাণী: “তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত” (আল-মায়িদাহ: ৫১)।”
উৎসবের সাথে ধর্মীয় চিন্তাধারার এই গভীর যোগসূত্রের কারণেই ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (স.) মুসলিমদের জন্য সুস্পষ্ট ভাষায় উৎসবের দিন-ক্ষণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ফলে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব-আয়োজনের সাথে ইসলামী উৎসব সংস্কৃতি সংমিশ্রিত বা সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। ইসলামী উৎসবের স্বাতন্ত্র তুলে ধরে রাসূল (স.) বলেন:
إِنَّ لِكُلِّ قَوْمٍ عِيدًا وَهَذَا عِيدُنَا
“প্রত্যেক জাতির নিজস্ব উৎসব রয়েছে, আর এটা আমাদের ঈদ।” [বুখারী: ৯৫২; মুসলিম: ৮৯২]
আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণিত:
قَدِمَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِينَةَ وَلَهُمْ يَوْمَانِ يَلْعَبُونَ فِيهِمَا ، فَقَالَ : ” مَا هَذَانِ الْيَوْمَانِ ؟ ” قَالُوا : كُنَّا نَلْعَبُ فِيهِمَا فِي الْجَاهِلِيَّةِ ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى قَدْ أَبْدَلَكُمْ يَوْمَيْنِ خَيْرًا مِنْهُمَا : يَوْمَ الْأَضْحَى وَيَوْمَ الْفِطْرِ ” .
“রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন [মদীনায়] আসলেন, তখন তাদের দুটো উৎসবের দিন ছিল। তিনি (সা.) বললেন, ‘এ দুটো দিনের তাৎপর্য কি?’ তারা বলল, ‘জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এ দুটো দিনে উৎসব করতাম।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘এ দিনগুলোর পরিবর্তে আল্লাহ তোমাদের উত্তম কিছু দিন দিয়েছেন: কুরবানীর ঈদ ও রোযার ঈদ ।” (সূনান আবু দাউদ)
এ হাদীস থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ইসলাম আগমনের পর ইসলাম বহির্ভূত সকল উৎসবকে বাতিল করে দেয়া হয়েছে এবং নতুনভাবে উৎসবের জন্য দুটো দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সাথে অমুসলিমদের অনুসরণে যাবতীয় উৎসব পালনের পথকে বন্ধ করা হয়েছে।
প্রিয় অভিভাবক! আপনার স্নেহের সন্তানকে যে বয়সে আপনি রশি ছেড়ে রেখেছেন বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালন করতে, সে বয়সে মুস‘আব বিন উমাইর [রা.] গিয়েছেন ওহোদ যুদ্ধে শহীদ হতে। আপনার সচেতনতার অভাবে যদি আপনার সন্তান নষ্ট হয় তবে আপনি ব্যর্থ অভিভাবক। জেনে রাখুন! রাসূল [সা.] বলেছেন, اَلاَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسئُوْلٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।[মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৮৫] সুতরাং আসুন! সেদিন আসার আগেই আমরা সচেতন হই, যেদিন আমার সন্তান আমার জান্নাতের গতিরোধ করবে।
.