ইমাম তিরমিজি (রহ.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

ইমাম তিরমিযির জীবনী
ইমাম তিরমিযির জীবনী

আলহামদুল্লিাহ। কওমী মাদরাসার ক্লাস আরম্ভ হয়ে গেছে। যারা এবার তিরমিযি শরীফ পড়াবেন তাদের জন্য ‘‘ইমাম তিরমিজি (রহ.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী’’এ প্রবন্ধটি।আমি অধমও পড়াব, তাই ভাবলাম  আপনাদের সাথেও শেয়ার করি। এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। আপনারা বিস্তারিত তথ্যসুত্রে দেয়া কিতাবগুলো থেকে বিস্তারিত পড়ে নিবেন ইনশাআল্লাহ!

নাম ও বংশ

ইমাম তিরমিজি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর প্রকৃত নাম- মুহাম্মদ। কুনিয়াত- আবূ ঈসা। তাঁর পিতার নাম ‘ঈসা। তার দাদার নাম সাওরা। তাঁর বংশপরিক্রমা হল: মুহাম্মদ ইবনে ‘ঈসা ইবনে সাওরা ইবনে মূসা ইবনে আয-যাহহাক আস-সুলামী আয-যরীর আল-বূগি আত-তিরমিজি।

জন্মগ্রহণ

ইমাম তিরমিজি (রহঃ) এর জন্ম তারিখ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। ইমাম তিরমিজি (রহঃ) এর জন্মসাল হিসাবে ২০৯ হিজরী (৮২৪/৮২৫ খ্রিঃ) উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে, ইমাম যাহাবি বলেন, ইমাম তিরমিজি (রহঃ) ২১০ হিজরীর (৮২৫/৮২৬ খ্রিঃ) কাছাকাছি সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। কেউ কেউ বলেন, ইমাম তিরমিজি (রহঃ) মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। আবার অনেকে বলেন, তিনি তিরমিজে জন্মগ্রহণ করেন (যেটি বর্তমানে উজবেকিস্তানের দক্ষিনে অবস্থিত)। প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী, তিনি ২০৯ হিজরীতে তিরমিজি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

শৈশবকাল

ইমাম তিরমিজি (রহঃ) শৈশবকাল নিজ জন্মভূমিতে কাটান। তবে, তিনি ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী এবং প্রখর বুদ্ধিমান ছিলেন। ফলে কোন হাদিসের প্রতি একবার চোখ বুলালে তা আর পুনরায় দেখার প্রয়োজন পড়তো না। সবাই তাঁর প্রখর মেধা দেখে আশ্চর্য হয়ে যেতো।

শিক্ষাজীবন

শৈশবকালে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে হাদিস শিক্ষা এবং হাদিস সংগ্রহে আত্মনিয়োগ করেন। ২০ বছর বয়সে তিনি হাদিস শিক্ষা শুরু করেন। তিনি মুসলিম জাহানের বিখ্যাত হাদিস শিক্ষাকেন্দ্রসমুহ বসরা, কুফা, ইরাক, খোরাসান, হিজাজে গমন করে হাদিস সংগ্রহ ও অধ্যয়ন করতেন। কোন কোন সময় ইমাম তিরমিজি (রহঃ) পরিবার পরিজন থেকে নিরুদ্দেশ থাকতেন।

অসাধারণ স্মৃতিশক্তি : 

ইমাম তিরমিযী রহ. ছিলেন অসাধারণ এবং বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তির অধিকারী। এ বিষয়ে শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দেসে দেহলভি রহ. বুসতানুল মুহাদ্দিসিনে একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। ইমাম তিরমিযী রহ. কোনো এক মুহাদ্দিসের কাছ থেকে হাদিসের দুটি পান্ডুলিপি ইজাজাতান লাভ করেছিলেন। অর্থাৎ ওই মুহাদ্দিস তাঁকে পাণ্ডুলিপি দুটিতে লিপিবদ্ধ হাদিসগুলো বর্ণনা করার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম তিরমিযী রহ. এর আকাঙ্ক্ষা ছিল পাণ্ডুলিপি দুটির বিষয়ে সরাসরি ওস্তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া।

একবার এক সফরে ওই ওস্তাদের সঙ্গে ইমাম তিরমিযী রহ. এর সাক্ষাৎ হলে তিনি নিজের বাসনার কথা তাঁকে জানান। ওস্তাদ বললেন ঠিক আছে, পাণ্ডুলিপি দুটি নিয়ে এসো। ইমাম তিরমিযী রহ. নিজ অবস্থানস্থলে গিয়ে তালাশ করে পাণ্ডুলিপি পেলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন হাদিসের পাণ্ডুলিপি বাড়িতে রয়ে গেছে, তার পরিবর্তে তিনি সাদা কাগজ নিয়ে এসেছেন। তিনি খুবই পেরেশান হলেন। অতঃপর সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে ইমাম তিরমিযী রহ. পাণ্ডুলিপিসদৃশ সাদা কাগজ নিয়ে ওস্তাদের সামনে বসে গেলেন। ওস্তাদ হাদিস পড়তে লাগলেন আর ইমাম তিরমিজি রহ. ওই কাগজের ওপর এমনভাবে চোখ ঘোরাতে লাগলেন, যেন তিনি ওস্তাদের পঠিত হাদিসের সঙ্গে পাণ্ডুলিপি মিলিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু একসময় ওস্তাদ বিষয়টি বুঝতে পারলেন। তিনি রেগে গিয়ে বললেন, তুমি আমার সঙ্গে মজা করছ? ইমাম তিরমিযী রহ. অত্যন্ত আদবের সঙ্গে ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করে বললেন, হজরত, আপনার পঠিত সব হাদিসই আমার স্মৃতিতে গেঁথে গেছে। আমি মুখস্থ করে নিয়েছি। ওস্তাদ তখন তাঁকে হাদিসগুলো শোনাতে বললেন। তখন তিনি সব হাদিস নির্ভুলভাবে শুনিয়ে দিলেন। অতঃপর ওস্তাদ তাঁকে পরীক্ষা করার জন্য অতিরিক্ত আরো ৪০টি হাদিস শোনালেন। ইমাম তিরমিযী রহ. সেগুলোও হুবহু শুনিয়ে দিলেন। ওস্তাদ আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘তোমার মতো আর কাউকে আমি কোনো দিন দেখিনি।’


তাঁর উস্তাদগণ

ইমাম তিরমিজি (রহঃ) অনেক মুহাদ্দিস থেকে হাদিস গ্রহন করেন বা শিক্ষার্জন করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উস্তাদগণ হলেন-

• ইমাম বোখারী

• আবু দাউদ

• মুসলিম বিন হাজ্জাজ

• মাহমুদ ইবনে গাইলান

• কুতাইবা ইবনে সাঈদ

তাঁর ছাত্রগণ

ইমাম তিরমিজি (রহঃ) খুব অল্প সময়ে হাদিসের পাণ্ডিত্য অর্জন করতে সক্ষম হন। ইমাম তিরমিজি রহঃ ছিলেন ইলমে হাদীসের এক বিশাল সাগর। ইমাম তিরমিজি রহ. এর পাণ্ডিত্য চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিদ্ধানুরাগী ও জ্ঞানপিপাসু ছাত্রগন তার নিকট থেকে হাদিসের দরস নিতে থাকেন। উল্লেখযোগ্য কিছু ছাত্র হলো-

• হুসাইন ইবনে ইউসূফ আল-ফিরবরী।

• হাম্মাদ ইবনে শাকির আল-ওয়ারাক।

• আহমদ ইবনে ইউসুফ নাসাফী (রহঃ)।

• রাবী ইবনে হাইয়ান আল-বাহিলী।

তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ

ইমাম তিরমিজি (রহ.) অনেক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-

১| আল-জামি আল-মুখতাসার মিন আস-সুনান আন-রাসুলিল্লাহ, (এটি জামে তিরমিজি নামে বেশ পরিচিত)

২| আশ-শামাইল আন-নাবাউয়িয়াহ ওয়া আল-ফাদাইল আল-মুসতাফাউয়িয়াহ।

৩| আল-আসমা ওয়া আল-কুনা।

৪| আজ-জুহদ।

৫| আল-ইলাল আস-সুগরা।

৬| আল-ইলাল আল-কুবরা।

৭| কিতাব আত-তারিখ।

মাজহাব

ইমাম তিরমিজি ইমাম বুখারীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিরমিজি শাফেয়ী বা হাম্বলী মাজহাবের অনুসারী ছিলেন। এমন হতে পারে যে তিনি নিজে একজন মুজতাহিদ ছিলেন অথবা ইমাম বুখারীর খুব ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কিছু অভিমত অনুযায়ী তিনি তার মাজহাব অনুসরণ করতেন।

মনীষীগণের অভিমত

১. ‘আল্লামা শামসুদ্দীন আয-যাহাবী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি মীযানুল ই’তিদাল ফী নকদির রিজাল গ্রন্থে বলেন,

......... محمد بن عيسى بن سورة؛ الحافظ، العلَم، الإمام، البارع

 “আবূ ঈসা আত-তিরমিযী ছিলেন হাফিয, ‘আলিম, জামি’ গ্রন্থের সংকলক নির্ভরযােগ্য এবং তাঁর বিশ্বস্ততার ব্যাপারে সকলেই একমত।”

২. আল্লামা আবূ ইয়ালা আল-খালীলী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, 

محمد بن عيسى بن سَوْرَة بن شدَّاد، الحافظ، متفق عليه، له كتاب في السنن وكلام في الجرح والتعديل، روى عنه ابن محبوب والأجلَّاء، وهو مشهور بالأمانة والعلم”

‘তিনি ছিলেন সকলের মতে নির্ভরযােগ্য.............। আমানতদারী এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রে ছিলেন প্রসিদ্ধ।’

৩. ইমাম হাফিয ইবনে হিব্বান রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন,

كان أبو عيسى الترمذي ممن جمع، وصنَّف، وحَفِظَ، وذاكر

 “আবূ ঈসা ছিলেন হাদীস মুখস্থকারী, সংগ্রহকারী ও সংকলনকারীগণের মধ্যে অন্যতম।

৪. ইমাম হাকিম আন-নিসাপুরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, “উমর ইবনে আলাক থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 

مات البخاري فلم يخلّف بخراسان مثل أبي عيسى، في العلم والحفظ والورع والزهد، بكى حتى عمي وبقي ضريراً سنين

ইমাম বুখারী তাঁর ইন্তিকালের পর খুরাসানে জ্ঞান, পরহেযগারী এবং দুনিয়া বিমুখিতার ক্ষেত্রে আবু ঈসা রহ.-এর অনুরূপ আর কাউকে রেখে যাননি। তিনি অধিক কান্নার জন্য অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং কয়েক বছর পর্যন্ত অন্ধাবস্থায় জীবনযাপন করেন।”

৫. ইমাম হাফিয মিযযী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, “তিনি ছিলেন উল্লেখযােগ্য হাফিযগণের মধ্যে অন্যতম এবং এমন এক ব্যক্তি, যার মাধ্যমে আল্লাহ মুসলমানগণকে উপকৃত করেছেন।”

দিদারে ইলাহী

ইমাম তিরমিজি (রহঃ) ২৭৯ হিজরীর ১৩ ই রজব সোমবার রাতে (৮ অক্টোবর ৮৯২ খ্রিঃ, বোরবার রাতে) বূগে ইন্তেকাল করেন। তাঁকে বর্তমানে উজবেকিস্তানের তিরমিজ থেকে ৬০ কি.মি. উওরে শিরাবাদে দাফন করা হয়। (সিয়ারু আলামিন নুবালা)

তথ্যসূত্রঃ الأعلام (6/322). البداية والنهاية (14/647).سير أعلام النبلاء (13/270/رقم 132).شذرات الذهب في أخبار من ذهب (3/327).العبر في خبر من غبر (1/402).الوافي بالوفيات (4/207).وفيات الأعيان (4/278/رقم 613).

সত্য প্রকাশ

আমার নামঃ মুফতি রেজাউল করিম। আমি একটি কওমী মাদরাসায় শিক্ষকতা করছি। পাশাপাশি এ ব্লগের সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। অনলাইন সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান থাকায় সময় পেলে দ্বীন ইসলাম নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করি। যেন অনলাইনেও মানুষ ইসলামি জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আপনিও চাইলে এ ব্লগে লিখতে পারেন। মোবাইলঃ 01782-40 91 69

Please Select Embedded Mode For Blogger Comments

নবীনতর পূর্বতন