মুফতি রেজাউল করিম |
এক. বয়ানে তিনি বললেন, "বিতর সালাত এক রাকাত পড়াটাই উত্তম৷ তিন রাকাতও পড়া যায়৷" এ কথার মাধ্যমে তিনি বোঝালেন এক রাকাত বিতর পড়াটাই মূল৷ আর হানাফীরা যে তিন রাকাত বিতর পড়ে তা গৌন৷ অর্থাৎ তিনি এক রাকাত বিতর পড়াকে সাজেস্ট করলেন৷
এবার দেখুন তাদেরই মতাদর্শের এক বড় ইমাম ও তাদেরই মান্যবর আব্দুল আজিজ বিন আব্দুল্লাহ ইবনে বায কী বলেন৷ এ মহান ব্যক্তি ছিলেন সৌদি আরবের বিখ্যাত ইসলামী পন্ডিত এবং সালাফি মতাদর্শের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। ১৯৯৩ সাল থেকে তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সৌদি আরবের প্রধান মুফতির পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এ বিখ্যাত ব্যক্তি বলেন, " বিতর নামায তিন রাকাত পড়া উত্তম৷"
দুই. মুযাফফর বিন মুহসিন আরো বলেন, " সুন্নত কে টিকিয়ে রাখার জন্য এক রাকাত বিতর বেশি বেশি পড়ুন৷" মুযাফফর বিন মুহসিনের কাছে আমার প্রশ্ন হলো, তিন রাকাত বিতর পড়া কি সুন্নত নয়? তিন রাকাত বিতর কি সাহাবায়ে কেরাম পড়তেন না? বিজ্ঞ আলেমদের মত অনুযায়ী তিন রাকাত বিতর পড়াই উত্তম৷ তাহলে কেন মুযাফফর বিন মুহসিন এক সুন্নত (তিন রাকত) মেরে ফেলে আরেক সুন্নত (এক রাকাত) জীবিত করার প্রমোট করলেন?
সহজ ভাষায় বলি, তিনি যেমন একটি সুন্নত জীবিত করতে বললেন তেমনি একটি সুন্নত মেরে ফেলতে বললেন৷ কারণ, এক রাকাত বিতর পড়তে তিন রাকাত পড়া হলো না৷ তাই তিন রাকাত বিতরের সুন্নতটি মরে গেলো৷ আরেকটা কথা বলি, মুযাফফর বিন মুহসিন সুন্নত জীবিত করার পরামর্শ দিয়েছেন৷ কারণ সুন্নত যিন্দা করার অনেক ফযিলতপূর্ণ সহীহ হাদীস রয়েছে৷
বাট তিনি " সুন্নত জীবিত" করার অর্থ ও মর্ম বোঝেননি৷ সুন্নত জীবিত করার মর্ম হলো, যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোনো একটি সুন্নতের ওপর কেউ আমল করে না৷ সেখানে ওই সুন্নতটি গুরুত্বের সাথে পালন করা ও মানুষকে দাওয়াত দেওয়া৷ যেমন মেসওয়াক করা৷
সুুন্নত জীবিত করার অর্থ এটা নয় যে, সুন্নাহর ভিন্নতার কোনো একটিকে বাদ দিয়ে অন্য একটি চালু করা৷ যেমন, নিম্নস্বরে আমীন বলা ও উচ্চস্বরে আমীন বলা উভয়টিই সুন্নত৷ তো কোনো এলাকায় নিম্নস্বরে পড়ার সুন্নতের উপর আমল চলছে সেখনে গিয়ে সুন্নত যিন্দা করার নামে উচ্চস্বরে আমীন বলার সুন্নতের প্রতি উৎসাহিত করা৷ এটা সুন্নত জীবিত করার হাদীসের ভুল প্রয়োগ৷ এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয়,
প্রচলিত এক সুন্নতকে বাতিল করে নতুন ও অপ্রচলিত একটি সুন্নত যিন্দা করা বৈধ নয়৷ বরং এতে ফিতনার আশঙ্কা রয়েছে৷ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ, মতিউর রহমান মাদানী, মুযাফফার বিন মুহসিনসহ কথিত আহলে হাদীস সম্প্রদায় মূলত এ ফিতনাই সৃষ্টি করছে৷ কি প্রয়োজন আছে তিন রাকাত বিতরের পরিবর্তে এক রাকাত বিতর পড়ার জন্য মানুষকে দাওয়াত দেওয়া? মুসলিম সমাজে সহীহ হাদীস মানার নামে অনৈক্য ও ফিতনা ক্রিয়েট করা?
এবার কিছু মৌলিক কথা বলি ৷ পয়েন্টগুলো মনে রাখুন৷
এবার কিছু মৌলিক কথা বলি ৷ পয়েন্টগুলো মনে রাখুন৷
১৷ শরীয়তে এমন কোনো সালাত নেই যা এক রাকাত পড়া যায়
২৷ দ্বিতীয় রাকাতে তাশাহহুদ নেই দুই রাকাতের অধিক এমন কোনো নামায নেই৷
৩৷ সকল সালাতের মূল কথা হলো, দ্বিতীয় রাকাতে বৈঠক আছে এবং তাশাহহুদ পড়তে হবে৷ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
في كل ركعتين التحية
অর্থাৎ প্রত্যেক দুই রাকাতে তাশাহহুদ রয়েছে৷ (সহীহ মুসলিম, ১/ ১৯৪)
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর বলেন,
ليس من صلاة الا وفيها قر ائة وجلوس في الركعتين
অর্থাৎ সব নামাযেরই কেরাত আছে আরও আছে দ্বিতীয় রাকাতে বসা৷ (মুসান্নাফ, ইবনে আবী শায়বা,৮৫৭৭)
বুখারীর এক রাকাত বিতর পড়ার হাদীসের মর্ম
সহীহ বুখারীর সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা গ্রন্থ "ফাতহুল বারী৷" এ কিতাবের রচয়ীতা ইবনে হাজার আসকালানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, বিতর নামায এক রাকাত পড়ার ক্ষেত্রে এ হাদীস সরীহ তথা স্পষ্ট নয়৷ এ হাদীসের অর্থ হলো,
صلي ركعة واحدة اي مضافة الي ركعتين مما مضي
অর্থাৎ তিনি এক রাকাত বিতর পড়েছেন অর্থাৎ পূর্বের দুই রাকাতের সাথে মিলিয়ে পড়লেন৷ (মোট তিন রাকাত বিতর পড়লেন)
শুধু তাই নয়, ইবনে হাজার আসকালানী রহিমাহুল্লাহ তিন রাকাত বিতর পরার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা নকল করেছেন৷ তিনি বলেন,
হানাফীগণ তিন রাকাত বিতর পড়েন কারণ তিন রাকাত বিতরের উপর সাহাবায়ে কেরামের ইজমা রয়েছে৷ তিন রাকা ছাড়া অন্যান্য রাকাত সংখ্যার পদ্ধতির উপর ইজমা নেই৷ তাই আমরা ইজমা সম্বলিত মত গ্রহণ করেছি৷
তিনি আরো বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা এক সালামে তিন রাকাত বিতর পড়তেন ৷ নামাযের মধ্যে কোনো সমস্যা হলে দ্বিতীয় রাকাতে সালাম ফিরিয়ে প্রয়োজন পূরণ করে এসে পূর্বের দুই রাকাতের উপর বেনা করে তিন রাকাত পূরণ করতেন৷ (ফাতহুল বারী, ২/৫৫৩)
প্রিয় পাঠক! এবার দেখুন তিন রাকাত বিতর পড়ার হাদীস৷
বিতর নামায তিন রাকাত সংক্রান্ত হাদীসে ভান্ডার থেকে কয়েকটি হাদীস আপনাদের সামনে তুলে ধরা হলো,
১৷ সা’দ ইবনে হিশাম বলেন, উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেছেন,
أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان لا يسلم في ركعتي الوتر
অর্থাৎ ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না।’
(সুনানে নাসায়ী ১/২৪৮; মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ১৫১)
২. ইমাম হাকেম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি সা’দ ইবনে হিশামের বর্ণনা এভাবে বর্ণনা করেছেন,
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يسلم في الركعتين الأوليين من الوتر. هذا حديث صحيح على شرط الشيخين ولم يخرجاه
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের প্রথম দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না।’
ইমাম হাকেম বলেন, এ হাদীসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ তবে তারা তাদের কিতাবে হাদীসটি আনেননি৷ (আলমুস্তাদরাক ১/৩০৪)
৩| অন্য সনদে বিবরণটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে,
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بثلاث، لا يسلم إلا في آخرهن. وهذا وتر أمير المؤمنين عمر بن الخطاب رضي الله عنه، وعنه أخذه أهل المدينة
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন এবং শুধু শেষ রাকাতে সালাম ফেরাতেন।
আমীরুল মু’মিনীন উমর রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এই নিয়মে বিতর পড়তেন এবং তাঁরই সূত্রে আহলে মদীনা এই নিয়ম গ্রহণ করেছে।
(আলমুস্তাদরাক)
৪৷ সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করেন,
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بثلاث يقرأ في الأولى سبح اسم ربك الأعلى وفي الثانية قل يا ايها الكافرون وفي الثالثة قل هو الله احد
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন, প্রথম রাকাতে সূরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা কাফিরুন এবং তৃতীয় রাকাতে সূরা ইখলাছ পড়তেন।
(সুনানে তিরমিযী ১/৬১; সুনানে নাসায়ী ১/২৪৯; শরহু মাআনিল আছার তহাবী ১/১৪০; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ১/২৯৯)
প্রিয় পাঠক! ইনসাফের দৃষ্টিতে এবার আপনি বিচার করুন৷ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ, মুযাফফার বিন মুহসিন সহ তথা কথিত আহলে হাদীস ওলামায়ে কেরাম উল্লিখিত বক্তব্য৷ তারা কি তাদের লেকচারের মাধ্যমে মানুষকে সহীহ হাদীসের দিকে দাওয়াত দিচ্ছে নাকি সমাজে অনৈক্য আর ফিতনা সৃষ্টি করছে৷
আজ এ পর্যন্তই ৷ ভালো থাকুন৷ সুস্থ্য থাকুন৷ সাথে থাকুন৷
প্রিয় পাঠক! ইনসাফের দৃষ্টিতে এবার আপনি বিচার করুন৷ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ, মুযাফফার বিন মুহসিন সহ তথা কথিত আহলে হাদীস ওলামায়ে কেরাম উল্লিখিত বক্তব্য৷ তারা কি তাদের লেকচারের মাধ্যমে মানুষকে সহীহ হাদীসের দিকে দাওয়াত দিচ্ছে নাকি সমাজে অনৈক্য আর ফিতনা সৃষ্টি করছে৷
আজ এ পর্যন্তই ৷ ভালো থাকুন৷ সুস্থ্য থাকুন৷ সাথে থাকুন৷