তাবিজ ব্যবহার করা কি শিরক ? একটি পর্যালোচনা

এক ভাই ফোনে জানতে চাইলেন যে, জনাব, তাবিজ ব্যবহার করা কি শিরক ? তিনি আরও বললেন, ইউটিউবে অনেক ভিডিও দেখলাম যেগুলোতে ঢালাওভাবে তাবিজ ব্যবহার করাকে শিরক বলা হয়েছে ৷ আমি এর সঠিক সমাধান জানতে চাই ৷ 

তাবিজ ব্যবহার করা কি শিরক ? একটি পর্যালোচনা

ভাই এ ধরনের আরও যে প্রশ্ন আমাদের কাছে এসে থাকে তার টাইটেল গুলো এমন, তাবিজ ব্যবহার করা কি হারাম ? তাবিজ ব্যবহার করা কি নাজায়েয ? ইসলামে তাবিজ ব্যবহারের বিধান কি ? ইত্যাদি ৷

যাই হোক তাবিজের বিস্তারি আলোচনা ৷ ইসলামে কয়েক প্রকার তাবিজ জায়েজ নয়। যেমন,

১৷ শুধু তামা, পিতল বা লোহা দ্বারা তাবিজ বানিয়ে লটকিয়ে রাখা। অর্থাৎ শুধু এগুলো লটকানো দ্বারাই রোগমুক্ত হওয়া যাবে বিশ্বাস করা ৷

২৷ এমন তাবিজ যাতে শিরকী কথা লিপিবদ্ধ থাকে।

৩৷ তাবীজ নিজেই আরোগ্য করার ক্ষমতার অধিকারী মনে করে তাবিজ লটকানো। এ বিশ্বাস জাহেলী যুগে ছিল, বর্তমানেও ইসলাম সম্পর্কে কিছু অজ্ঞ ব্যক্তিরা তা মনে করে থাকে।

৪৷ যে কালামের অর্থ জানা যায় না এমন শব্দ দ্বারা তাবিজ লেখা।

৫৷ আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষায় তাবিজ লেখা।

এ সকল সুরতে সর্বসম্মত মতানুসারে নাজায়িজ ও হারাম এবং শিরক। এতে কোন সন্দেহ নেই।

কিন্তু তাবিজে কুরআনের আয়াত, আল্লাহর নাম, দুআয়ে মাসুরা বা শিরকমুক্ত অর্থবোধক থাকলে তা অবশ্যই জায়িজ। একে নাজায়িজ ও শিরক বলা মুর্খতা বৈ কিছু নয়। কেননা এসব তাবিজের ক্ষেত্রে  আরোগ্যের ক্ষমতা আল্লাহ তাআলাকেই মনে করা হয়। 

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের দলিল

عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُعَلِّمُهُمْ مِنَ الْفَزَعِ كَلِمَاتٍ: «أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ، مِنْ غَضَبِهِ وَشَرِّ عِبَادِهِ، وَمِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ وَأَنْ يَحْضُرُونِ» وَكَانَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عُمَرَ يُعَلِّمُهُنَّ مَنْ عَقَلَ مِنْ بَنِيهِ، وَمَنْ لَمْ يَعْقِلْ كَتَبَهُ فَأَعْلَقَهُ عَلَيْهِ

অনুবাদঃ আমর ইবনে শুআইব তাঁর পিতা ও তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে,রাসূল (সঃ) ইরশাদ করেন,তোমাদের কেউ যখন ঘুম অবস্থায় ঘাবড়িয়ে উঠে,সে যেন 

 أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ، مِنْ غَضَبِهِ وَشَرِّ عِبَادِهِ، وَمِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ وَأَنْ يَحْضُرُونِ

এ দো’আটি পাঠ করে। 

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর তাঁর উপযুক্ত সন্তানদের তা শিক্ষা দিতেন এবং ছোটদের গলায় তা লিখে লটকিয়ে দিতেন। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৩৮৯৫]

এ হাদীস স্পষ্টভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ বিন উমর রাঃ তাঁর অবুঝ সন্তানদের জন্য তাবীজ লিখে তা লটকিয়ে দিতেন।

যারা বলেন যে, সকল তাবিজই শিরক, তাহলে আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রাঃ কি শিরক করেছেন? নাউজুবিল্লাহ!

যে সব হাদীসে তাবীজকে হারাম শিরক বলা হয়েছে এর জবাব কি?

তাবীজ কবচ সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত হাদীসে সেসব তাবীজকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে যেসব তাবীজের কথা ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখিত ৫ ধরণের নিষিদ্ধ তাতো আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। নিষিদ্ধতার হাদীসে কেবল সেসবই উদ্দেশ্য। এ কারণেই আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রাঃ তার সন্তানদের তাবিজ দিতেন। যাতে উল্লেখিত শর্তের কোনটি বিদ্যমান নয়।

দেখুন বিজ্ঞ ওলামা ও ফক্বীহরা কী বলেন?

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে লিখেন-

وَالتَّمَائِمُ جَمْعُ تَمِيمَةٍ وَهِيَ خَرَزٌ أَوْ قِلَادَةٌ تُعَلَّقُ فِي الرَّأْسِ كَانُوا فِي الْجَاهِلِيَّةِ يَعْتَقِدُونَ أَنَّ ذَلِكَ يَدْفَعُ الْآفَاتِ وَالتِّوَلَةُ بِكَسْرِ الْمُثَنَّاةِ وَفَتْحِ الْوَاوِ وَاللَّامِ مُخَفَّفًا شَيْءٌ كَانَتِ الْمَرْأَةُ تَجْلِبُ بِهِ مَحَبَّةَ زَوْجِهَا وَهُوَ ضَرْبٌ مِنَ السِّحْرِ وَإِنَّمَا كَانَ ذَلِكَ مِنَ الشِّرْكِ لِأَنَّهُمُ أَرَادُوا دَفْعَ الْمَضَارِّ وَجَلْبَ الْمَنَافِعِ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللَّهِ وَلَا يَدْخُلُ فِي ذَلِكَ مَا كَانَ بِأَسْمَاءِ اللَّهِ وَكَلَامِهِ فَقَدْ ثَبَتَ فِي الْأَحَادِيثِ اسْتِعْمَالُ ذَلِكَ قَبْلَ وُقُوعِهِ

অনুবাদঃ তামায়েম শব্দটি তামীমা শব্দের বহুবচন। যা পুঁতি বা মালা সাদৃশ্য। মাথায় লটকানো হয়। জাহেলী যুগে বিশ্বাস করা হতো যে, এর দ্বারা বিপদমুক্ত হওয়া যায়, মহিলারা এসব ব্যবহার করতো স্বামীর মোহাব্বত অর্জন করতে। এটি জাদুরই একটি প্রকার। এটি শিরকের অন্তুর্ভূক্ত। কেননা এর দ্বারা আল্লাহ ছাড়া অন্যের থেকে বিপদমুক্ত হওয়া ও উপকার অর্জন করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। কিন্তু এ শিরকের অন্তুর্ভূক্ত হবে না যেসব তাবীজ কবচে আল্লাহর নাম বা কালাম থাকে। [ফাতহুল বারী-১০/২৯০-২৯১, ঝারফুক অধ্যায়]

মোল্লা আলী কারী রহঃ বলেন,

إِذَا كَتَبَ لَهُ النُّشْرَةَ، وَهِيَ كَالتَّعْوِيذِ. وَالرُّقْيَةِ، وَالْمُرَادُ بِالضَّمِيرِ الْبَارِزِ فِي قَوْلِهِ: (فَقَالَ) : أَيِ: النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: (هُوَ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ) : النَّوْعُ الَّذِي كَانَ أَهْلُ الْجَاهِلِيَّةِ يُعَالِجُونَ بِهِ وَيَعْتَقِدُونَ فِيهِ، وَأَمَّا مَا كَانَ مِنَ الْآيَاتِ الْقُرْآنِيَّةِ، وَالْأَسْمَاءِ وَالصِّفَاتِ الرَّبَّانِيَّةِ، وَالدَّعَوَاتِ الْمَأْثُورَةِ النَّبَوِيَّةِ، فَلَا بَأْسَ، بَلْ يُسْتَحَبُّ سَوَاءٌ كَانَ تَعْوِيذًا أَوْ رُقْيَةً أَوْ نَشْرَةً، وَأَمَّا عَلَى لُغَةِ الْعِبْرَانِيَّةِ وَنَحْوِهَا، فَيَمْتَنِعُ لِاحْتِمَالِ الشِّرْكِ فِيهَا.

অনুবাদঃ যদি তাবীজের মত কাগজ লিখা হয়। রাসূল সাঃ এর বানী “এটি শয়তানী কর্ম” এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল জাহেলী যুগে যদ্বারা চিকিৎসা করা হতো ও যার উপর নির্ভর করা হতো। আর যা কুরআনের আয়াত, আল্লাহর নাম, আল্লাহর সিফাত সম্বলিত, দুআয়ে মাসুরা হয়, তাহলে কোন সমস্যা নেই। বরং এটি মুস্তাহাব। চাই সেটি তাবীজ হোক, বা ঝারফুক হোক বা কাগজে লিখা হোক। আর যেসব ইবরানী ও অন্যান্য ভাষায় লিখা হয় তা নিষিদ্ধ। কারণ তাতে শিরকের সম্ভাবনা আছে। [মিরকাতুল মাফাতীহ-৮/৩৭৩, বর্ণনা নং-৪৫৫৩]

আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রহঃ উল্লেখ করেন,

إنَّمَا تُكْرَهُ الْعُوذَةُ إذَا كَانَتْ بِغَيْرِ لِسَانِ الْعَرَبِ، وَلَا يُدْرَى مَا هُوَ وَلَعَلَّهُ يَدْخُلُهُ سِحْرٌ أَوْ كُفْرٌ أَوْ غَيْرُ ذَلِكَ، وَأَمَّا مَا كَانَ مِنْ الْقُرْآنِ أَوْ شَيْءٍ مِنْ الدَّعَوَاتِ فَلَا بَأْسَ بِهِ


অনুবাদঃ নিশ্চয় নিষিদ্ধ তাবীজ হল যা আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় লিখা হয়, বুঝা যায় না তাতে কি আছে? অথবা যাতে জাদু, কুফরী ইত্যাদি কথা থাকে। আর যেসব তাবীজে কুরআন বা দুআ সম্বলিত হয় তা ব্যবহারে কোন সমস্যা নেই। [ফাতওয়ায়ে শামী-৬/৩৬৩]

কথিত আহলে হাদীস ভাইদের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের মতামত

কথিত আহলে হাদীস নামধারী ভাইদের কাছেও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন-

يَجُوزُ أَنْ يَكْتُبَ لِلْمُصَابِ وَغَيْرِهِ مِنْ الْمَرْضَى شَيْئًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ وَذِكْرُهُ بِالْمِدَادِ الْمُبَاحِ وَيُغْسَلُ وَيُسْقَى كَمَا نَصَّ عَلَى ذَلِكَ أَحْمَد وَغَيْرُهُ

অনুবাদঃ বিপদগ্রস্ত বা অসুস্থ লোকদের জন্য কারি দ্বারা আল্লাহর কিতাব,আল্লাহর জিকর লিখে দেয়া এবং ধুয়ে পান করা জায়েজ।

তারপর এ আলোচনার শেষদিকে তিনি তাবিজাত বৈধ হওয়ার পক্ষে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর একটি আছার পেশ করেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) কাগজের টুকরায় তাবিজ লিখে দিতেন,তা সন্তানসম্ভবা নারীদের বাহুতে বেঁধে দেয়া হত। {ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া-১০/৩৭}

আল্লামা শাওকানী রহঃ নাইলুলআওতারে,  ঝারফুক ও তাবীজের অধ্যায়ে স্পষ্ট ভাষায় উপরোক্ত শর্ত সাপেক্ষের তাবীজকে জায়েজ লিখেছেন। [নাইলুল আওতার-৮/২৪২] সকল প্রকার তাবীজ নাজায়িজ হলে ঝাড়ফুঁকও না জায়েজ হয়

কথিত আহলে হাদীস ভাইয়েরা তাবীজ কবচকে আমভাবে না জায়িজ বলার জন্য যেসব হাদীস দলিল হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে সেসব হাদীসের মাঝে একটি হাদীস হল-

إِنَّ الرُّقَى، وَالتَّمَائِمَ، وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ

অনুবাদঃ অবশ্যই ঝাড়ফুঁক, তাবীজ ও জাদু শিরক। {সুনানে আবু দাউদ,হাদীস নং-৩৮৮৩, ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৩৫৩০}

এ হাদীসে ঝাড়ফুঁককেও শিরক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাহলে কি সকল প্রকার ঝাড়ফুঁক শিরক ও হারাম? আমাদের কথিত আহলে হাদীস ভাইয়েরাও তা স্বীকার করেন যে, কুরআন ও দুআয়ে মাসুরা দ্বারা ঝাড়ফুঁক জায়েজ।এছাড়া হলে নাজায়িজ। 

তাহলে এ হাদীস দিয়ে তাবীজ নিষিদ্ধের দলিল দেয়া কি ঠিক হবে? ঝাড়ফুঁক জায়েজের যেমন ব্যখ্যা দেয়া হয় যে, এখানে সর্বপ্রকার ঝাড়ফুঁক উদ্দেশ্য নয়, তেমনি আমরা বলেি, তাবীজ নিষিদ্ধতার হাদীসে সব ধরণের তাবীজ নিষিদ্ধের কথা উদ্দেশ্য নয়। যেমনটি বিজ্ঞ আলেমগণের মতমত উল্লেখ পূর্বক ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ হলো তাবিজ ব্যবহার করা কি শিরক ? তাবিজ ব্যবহার করা কি হারাম ? এর সংক্ষিপ্ত আলোচনা ৷ বিস্তারিত জানার জন্য নির্ভরযোগ্য কোন মুফতির নিকট গিয়ে জেনে নিবেন ৷

সত্য প্রকাশ

My name: Mufti Rezaul Karim. I am teaching in a communal madrasah, I try to write something about Deen Islam when I have time because I have a fair amount of knowledge about online. So that people can acquire Islamic knowledge online. You can also write on this blog if you want.

Please Select Embedded Mode For Blogger Comments

নবীনতর পূর্বতন