আজকাল আমাদের দেশে আলেমদের নামের আগে আল্লামা শব্দের ব্যবহার এত বেশি বেড়েছে যে, যে ব্যক্তি আরবী ইবারত 4/5 লাইন পড়তে পারে না কিংবা কুরআন-হাদীসের জ্ঞানে মোটেই পারদর্শী নয়, তার নামের আগেও আল্লামা শব্দের ব্যবহার দেখা যায়, যা খুব দুঃখজনক ও হাস্যকর।তাই আজ আলোচনা করব, আল্লামা কাকে বলে? আল্লামা শব্দের অপপ্রয়োগ নিয়ে। এ ব্যাপারে মুফতি রফি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম বলেন, ‘‘বর্তমান সময়ে আল্লামা একটি মজলুম ইস্তেলাহ বা নিপীড়িত পরিভাষা। আল্লামা এত সহজ বিষয় নয় যে কারো নামের আগে লাগিয়ে দিলেই সে আল্লামা হয়ে যাবে বড় আল্লামা হওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার ।’’ আল্লামা একটি সর্বোচ্চ সম্মানজনক উপাধি । সুতরাং একে যেথায় সেথায় অপাত্রে ব্যবহার করা মোটেই ঠিক নয় ।
আল্লামা শব্দের শাব্দিক বিশ্লেষণঃ
আরবি ইলম (علم) শব্দের অর্থ জ্ঞান। এখান থেকে এসেছে আলিম (عالم) বা জ্ঞানী। আলিম শব্দের মুবালাগা বা সুপারলেটিভ ডিগ্রি হচ্ছে আল্লামা(علامة); যার অর্থ অত্যন্ত জ্ঞানী বা মহাজ্ঞানী।
কামুসুল আলকাব গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘আল্লামা’ মুবালাগার সিগা (যা কোনো দোষ বা গুণের আধিক্য বোঝায়)। সাধারণ জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য এ শব্দ ব্যবহার করা শুদ্ধ নয়। যদি না ব্যক্তির জ্ঞানচর্চায় গভীর পাণ্ডিত্য ও স্বতন্ত্র অবস্থান না থাকে।
‘আল্লামা’ শব্দের পারিভাষিক অর্থঃ
এমন কিছু পরিভাষা থাকে যার অর্থ এক শব্দে করা যায় না বরং বিস্তারিত ভাবে বলতে হয় । তদ্রুপ আল্লামা শব্দটিও। এই শব্দের পারিভাষিক অর্থ এক শব্দের মাধ্যমে বলাটা খুব মুশকিল। তাই আসুন বিস্তারিত জেনে নেই, একজন ব্যক্তির মধ্যে বা একজন আলেমের মধ্যে কী কী গুন থাকলে তাকে আল্লামা বলা যেতে পারে।
‘আল্লামা’ শব্দের ব্যবহার আরবরা কিভাবে করেন?
আল্লামা শব্দের ব্যবহার আরবরা খুব কম করেন। কোনো ব্যক্তি যদি কোনো শাস্ত্রে বিশেষ পাণ্ডিত্য ও সাধারণভাবে তার স্বীকৃতি লাভ করেন তবেই তার ক্ষেত্রে আল্লামা শব্দটি ব্যবহার করা হয়। যেমন কেউ তাফসিরে পণ্ডিত তাকে বলা হয় আল্লামা ফিত তাফসির।
তবে কারো পাণ্ডিত্য যদি সর্বজন বিধিত না হয় তবে তারা ‘তালিবুল ইলম’ বা জ্ঞানান্বেষী শব্দটি ব্যবহার করেন। এমনকি বিখ্যাত অধ্যাপকরা পর্যন্ত নিজেদের ‘তালিবুল ইলম’ পরিচয় দিতে সাচ্ছ্বন্দবোধ করেন।
আরোও পড়ুনঃ মাওলানা বলা কি শিরক? আলেমদের মাওলানা বলা কি হারাম?
আল্লামা’ শব্দ ব্যবহারে শরিয়তের বিধান
এখানে দুটি শব্দ। এক. আল্লাম, দুই. আল্লামা। আল্লাম শব্দটি আল্লাহ নিজের জন্য ব্যবহার করেছেন। তাই তা কোনো মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা উচিৎ নয়। অনেকে বলেন, হজরাতুল আল্লাম। এটি অনুচিৎ।’
‘আর মানুষের ক্ষেত্রে আল্লামা শব্দটি ব্যবহার করা বৈধ। তবে তা সবার জন্য নয়। আরব রীতি অনুযায়ী কেবল কোনো শাস্ত্রের পণ্ডিতরাই তার নামের সঙ্গে আল্লামা শব্দটি ব্যবহার করতে পারেন। অন্য কেউ নন।
যার নামের সঙ্গে ব্যবহার করা হবে তিনি যে শাস্ত্রে পণ্ডিত তাও সেখানে উল্লেখ করতে হবে। যেমন, আল্লামা ফিন নাহব, আল্লামা ফিত তারিখ ইত্যাদি।
আল্লামা হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে,সেই শর্তসাপেক্ষে কাউকে আল্লামা বলা যেতে পারে। ইসলামি গবেষকদের মতে,আল্লামা তাদেরকে বলা যায়,”যারা জামে’উল মানকুলাত -ওয়াল মা’কুলাত বিষয়ে অভিজ্ঞ অর্থাৎ উলূমে নাকলিয়া এবং উলূমে আকলিয়ায় সমানভাবে যিনি দক্ষ হবেন তিনিই আল্লামা”।
ইলমে মানকুলাত বলতে ওই শাস্ত্রকে বোঝানো হয়, যা উক্তি ও বর্ণনানির্ভর, যার মধ্যে কিয়াস বা যুক্তি চলে না। যেমন- ইলমে আকাইদ,ইলমে ফারায়িয,ইলমে হাদীস,ইলমে নাহব,ইলমে সরফ,ইলমে রিজাল,ইলমে তারীখ,ইলমে বালাগাত,ইলমে লুগাত,ইত্যাদি।
আর ইলমে মা’কুলাত বলতে ওই শাস্ত্রকে বোঝানো হয়, যার মধ্যে কিয়াস, যুক্তি ও বুদ্ধি খাটাতে হয়, যেমন-ইলমে ফিকহ,ইলমে মানতিক, ইলমে কালাম,ইলমে হাইয়াত,ইলমে ফালসাফা ইত্যাদি।
তাহলে আল্লামা তাঁকেই বলা যাবে,যিনি একই সাথে মুহাদ্দিস, মুফতী, মুফাসসির, মুফাক্কির, হাদীসবিশারদ, আরবী ভাষাবিদ, সাহিত্যিক, ফায়লাসুফ, ইতিহাসবিদ, মানতিকবিদ ও অলঙ্কার শাস্ত্রবিদ তথা ইলমে শরিয়তের সব শাস্ত্রে দক্ষ-অভিজ্ঞ হবেন।
উপরের শর্তসাপেক্ষে বলা যায়,যিনি শরীয়তের মৌলিক শাস্ত্রে অভিজ্ঞ, একমাত্র তাকেই আল্লামা বলা যেতে পারে।বিশেষ বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তিকে সেই বিশেষ বিষয়ের উপাধি দেওয়া যায়,যেমন -যিনি হাদীস শাস্ত্রে অভিজ্ঞ তাকে শায়খুল হাদীস, যিনি ইলমে ফিকহ শাস্ত্রে অভিজ্ঞ তাকে মুফতী, কিংবা তাফসীর শাস্ত্রে অভিজ্ঞ তাকে শায়খুত তাফসীর বা মুফাসসির, যিনি কেরাত শাস্ত্রে অভিজ্ঞ তাকে শায়খুল কুররা বলা যায়। কিন্তু কাউকে আল্লামা বলতে হলে, অনন্তপক্ষে উপরের বিষয়গুলো প্রতি খেয়াল রেখে তাকে যদি যোগ্য মনে করেন তাহলে আল্লামা বলতে পারেন।
আলিম যে কাউকে বলা যায়,প্রত্যেক জ্ঞানী লোক এক একজন আলিম।কিন্তু আল্লামা এতো সহজ উপাধি নয় যে,কেউ সামান্য গরম ওয়াজ কিংবা সামান্য সুর দিয়ে ওয়াজ করতে পারলেই তাকে আল্লামা উপাধি দিয়ে দিবেন।সুতরাং কাউকে আল্লামা বলতে হলে একটু চিন্তা-ভাবনা করা উচিৎ।যাকে আল্লামা বলা হচ্ছে, তিনি কি উল্লিখিত সকল বিষয়ে পারদর্শী?
আরোও পড়ুনঃ মুসাফাহা দুই হাতে করা সুন্নাত না এক হাতে? মুসাফাহা করার নিয়ম
ভারত উপমহাদেশে আল্লামা শব্দের প্রথম ব্যবহৃত
ভারতীয় উপমহাদেশে এ উপাধিটি প্রথম ও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় ভারতীয় মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা কবি ও দার্শনিক মুহাম্মদ ইকবালের ব্যাপারে। তিনি ভারতবর্ষের প্রথম খ্যাতিমান ‘আল্লামা’। যদিও তাকে আল্লামা বলা নিয়েও উলামাদের মধ্যে ইখতেলাফ রয়েছে, কিন্তু তার আল্লামা উপাধিটি সর্বমহলে জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছে।
তার পূর্বে ভারতবর্ষের জগদ্বিখ্যাত আলেমদের নামের সঙ্গেও এতোটা বিস্তৃত পরিসরে আল্লামা ব্যবহার করা হতো না। তাদের নামের সঙ্গে ব্যবহৃত হতো মাওলানা বা মৌলভি। খুব বেশি হলে শায়খুল হাদিস,শায়খুত তাফসীর, শায়খুল ইসলাম, শায়খুল আদব, মুফতী ইত্যাদি। যেমন, মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহঃ, সাইয়েদ মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহঃ, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহঃ, মাওলানা আবুল হাসান নদভী, মুফতী তাকি উসমানী।
মুহিউদ্দীন খান রহঃ আল্লামা বলা অপছন্দ করতেন
একবার মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেবকে কোন ওয়াজে আল্লামা বলা হলো, তিনি সাথে সাথেই রাগ করে বলে উঠলেন, যেখানে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আলেম আশরাফ আলী থানবী, শামসুল হক ফরিদপুরী কিংবা শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানীকে মাওলানা বলা হয়, সেখানে আমার নামের আগে আল্লামা বলছ, তোমাদের সাহস ত কম না? চিন্তা করুন, তার মতো মহান ব্যাক্তি যেখানে নিজের নামের আগে আল্লামা শব্দের ব্যবহার করতে সাহস করেন নি, সেখানে আমাদের প্রাইমারী লেভেলের আলেমরা নিজেদের নামের আগে আল্লামা ব্যবহারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন। আমি এমন অনেককেই চিনি, যারা আল্লামা শব্দের তাহকিকও করতে পারবে না তারাও আজ আল্লামা অমুক ৷
বক্তা মানেই আল্লামা
সময়ের বিবর্তনে আল্লামা শব্দের ব্যবহার বর্তমানে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে এই আল্লামা শব্দের ব্যবহার আমাদের দেশের ওয়াজী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ব্যবহার হয়ে থাকে। আমি এমন অনেককে জানি যারা প্রত্যেক ক্লাসে কোন না কোন বিষয়ে ফেল করতো । তারা এখন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বক্তা, বিশ্বনন্দিত মুফাসসিরে কুরআন ও আল্লামা । কারণ তাদের কণ্ঠে জাদু আছে কথা বলতে পারে সুর দিয়ে । বাস, ক্লাসে ফেল করেও সে এখন আল্লামা । নূরানী মাদ্রাসার মুহতামিম তিনিও আল্লামা। আল্লামা কাকে বলে? আল্লামা শব্দের অপপ্রয়োগ বুঝলেন তো
এবার চিন্তা করুন! আল্লামা শব্দের উপাধীর প্রতি আমাদের দেশে কি পরিমাণ জুলুম করা হচ্ছে? আসুন, আল্লামা শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন হই।সাধারণ একজন কামিল পাশ/দাওরায়ে হাদীস পাশ ওয়াজী হুজুরের নামের সাথেই যেনো আল্লামা উপাধি লাগিয়ে না দেই।কারণ আল্লামা শব্দের অপব্যবহারে প্রকৃত আল্লামাদেরকে অবমাননা করা হচ্ছে।আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে একনিষ্ঠ ভাবে তার ইবাদত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
আরোও পড়ুনঃ আবু ত্বহা আদনানেরি বিভ্রান্তির জবাব