ওযুতে গর্দান মাসাহ করা সুন্নাত নাকি বিদআত

ওযুতে গর্দান মাসেহ করা সুন্নাত নাকি  বিদআত?-মুফতি রেজাউল করিম।  আমাদের সমাজে এক শ্রেণীর লোক রয়েছে যাদেরকে আমরা আহলে হাদিস বা সালাফি নামে চিনি। তারা জোর গলায় একটি কথা বলেন যে, গর্দান মাসেহ করা বিদা'আত। গর্দান মাসাহ সম্পর্কে যত হাদীস রয়েছে সবগুলোই দুর্বল। সুতরাং গর্দান মাসেহ করা বিদআত। আমি আজকের এই প্রবন্ধে প্রমাণ করব যে, গর্দান মাসেহ করা বিদআত নয় বরং মুস্তাহাব;  যা অসংখ্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।  তাহলে আসুন গর্দান মাসেহ করা হুকুম জেনে নেই । নিম্নে গর্দান মাসেহ করার হুকুম ও দলিল উপস্থাপন করা হলো।

গর্দান মাসাহ করা মুস্তাহাব।


যারা গর্দান বা ঘাড় মাসেহ করাকে বিদআ’ত বলেন, তাদের কথা ঠিক নয়। না জানার কারণে তারা এমনটি বলে থাকেন। কেননা, প্রকৃত পক্ষে অজুতে গর্দান বা ঘাড় মাসেহ করা মুস্তাহাব। গলা মাসেহ করা বিদআ’ত। (হাশিয়াতুত তাহাবী আলা মারাকিয়িল ফালাহ, ১/১১৫, ১/১১২) এর পক্ষে রয়েছে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত হাদিস ।  তিনি বলেন,  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন , 


مَنْ تَوَضَّأَ وَمَسَحَ بِيَدَيْهِ عَلَى عُنُقِهِ وُقِيَ الْغُلَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ 

অর্থাৎ যে ব্যক্তি অজু করে এবং উভয় হাত দিয়ে গর্দান মাসাহ করে, তাহলে তাকে কিয়ামতের দিন [আযাবের] বেড়ি থেকে বাঁচানো হবে।


     আমার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করতেঃ  এখানে ক্লিক করুন 


হাদিসটির মান:

এ হাদীসের মান সম্পর্কে ইমাম আবুল হাসান ফারেছ রহঃ বলেছেন,


 هَذَا إنْ شَاءَ اللَّهُ حَدِيثٌ صَحِيحٌ


ইনশাআল্লাহ হাদীসটি সহীহ। [তালখীসুল হাবীর-১/৯৩, দারুল কুতুব প্রকাশনী-১/২৮৮,মুআসসা কুরতুবিয়্যাহ প্রকাশনী-১/১৬৩]


প্রখ্যাত তাবেয়ী মুসা ইবনে তলা থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেন, 

 ﻣﻦ ﻣﺴﺢ ﻗﻔﺎﻩ ﻣﻊ ﺭﺃﺳﻪ ﻭﻗﻲ ﺍﻟﻐﻞ ﻳﻮﻡ ﺍﻟﻘﻴﺎﻣﺔ

অর্থাৎ যে ব্যক্তি মাথার সাথে গর্দানকেও মাসেহ করবে,ক্বিয়ামতের দিন জান্নামের বেড়ী পড়ানো থেকে তাকে মুক্ত রাখা হবে”। ( তালখীসুল হাবীর ১/১৬২,  নাইলুল আওতার ১/২০৩)

হাদিসটির মান:

এ হাদীসের মান সম্পর্কে হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ বলেন,

فيحتمل أن يقال هذا وإن كان موقوفا فله حكم الرفع لان هذا لا يقال من قبل الرأي فهو على هذا مرسل

অর্থাৎ বর্ণনাটি সম্পর্কে একথা বলা যায় যে, যদিও তা মাওকুফ (একজন তাবেয়ীর কথা) হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে তা মারফুউ (রাসূলুল্লাহ সাঃ এর হাদীস) হিসাবে গণ্য হবে। কেননা, তিনি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এমন সংবাদ দেওয়া সম্ভব নয়। (তালখীসুল হাবীর ১/১৬২,  নাইলুল আওতার ১/২০৩)

শুধু তাই নয়,  আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও গর্দান মাসেহ করতেন নিচের হাদিসটি ভালো করে দেখু।  হযরত তালহা তিনি তার পিতা, তিনি তার দাদারসূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন,

رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَوَضَّأَ فَمَسَحَ رَأْسَهُ هَكَذَا وَأَمَرَّ حَفْصٌ بِيَدَيْهِ عَلَى رَأْسِهِ حَتَّى مَسَحَ قَفَاهُ

অর্থ: আমি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, তিনি অজু করছেন। তখন তিনি এভাবে মাথা মাসাহ করেছেন। উভয় হাতকে জমা করে পাস কাটিয়ে তা দিয়ে গর্দান মাসাহ করতেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ১ /২৯১) 

এ হাদিস স্পষ্ট বুঝায় আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গর্দান মাসেহ করতেন।  আমার আহলে হাদীস ভাইদের নিকট প্রশ্ন হল,  যে আমলটি আল্লাহর নবী স্বয়ং করতেন তাকে কিভাবে বিদআত বলেন? আপনার বিবেক কি একটু বাধা দেয় না?

আরো পড়ুনঃ  বিতিরের সালাত নিয়ে মুজাফফর বিন মহসিন এর মিথ্যাচার 

আহলে হাদীসদের খোঁড়া যুক্তি ও আমাদের উত্তর 

প্রিয় পাঠক, ওযুতে ঘাড় বা গর্দান মাসাহ করার ব্যাপারে উপরোক্ত হাদিসগুলো যখন আমরা পেশ করে থাকি, তখন আহলে হাদিসের ভাইয়েরা অভিযোগ বসেন যে, উক্ত হাদিসগুলো সব যয়ীফ বা দুর্বল। সুতরাং যয়ীফ হাদিসের উপর আমল করা বিদআত।

জবাবে আমরা বলব, আমরা যদি ধরেও নিই যে, “ওযুতে ঘাড় মাসাহের ব্যাপারে যত হাদিস বর্ণিত হয়েছে সব হাদিস যয়ীফ” তবুও ঘাড় মাসাহকে বিদ’আত বলার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সকল উলামায়ে হাদিসের নিকট যয়ীফ হাদিসের উপর আমল করা জায়েয রয়েছে। খোদ আহলে হাদিসের ফাতাওয়ার কিতাবে বর্ণিত হয়েছে,

حدیث ضعیف سے جو موضوع نہ ہو استحباب و جواز ثابت ہوتا ہے

অর্থাৎ যেটা জাল নয় এমন যয়ীফ হাদিস দ্বারা (যেকোনো আমল) মুস্তাহাব এবং জায়েয প্রমাণ হয়। (ফাতাওয়ায়ে উলামায়ে হাদিস পৃ: ২১৭) সুতরাং হাদিসগুলো যয়ীফ হলেও “ওযুতে ঘাড় মাসাহকে বিদআত” বলার কোনো সুযোগ রইল না।

আরো পড়ুনঃ  যয়ীফ হাদিস কি আমলযোগ্য নয় কি বলেন বিখ্যাত স্কলারগণ? 

ভাবতে বড়ই আশ্চার্য লাগে! কিছু মানুষ উম্মাতে মুসলিমার আমল এবং হাদীস গ্রহণের নীতিমালাকে জলাঞ্জলি দিয়ে নতুন কিছু বলা বা করার নেশায় বিভোর হয়ে পড়েছে। সহীহ হাদীস না পাওয়ার অজুহাতে গর্দান মাসেহ-এর ফযীলাতকে অস্বীকার করে বসেছে। এটাকে বিদআত বলে সমাজে অপপ্রচার চালাচ্ছে। অথচ যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসগণসহ উম্মাতে মুসলিমার বিরাট অংশ এটাকে গ্রহণ করেছে।

প্রিয় পাঠক, “গর্দান মাসেহ করা সুন্নাত ও বিদআত” এর ব্যাপারে উপরোক্ত আলোচনা থেকে আশা করি আর বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। নবীজি সা. এর হাদিসসহ খোদ আহলে হাদিস ও সালাফীদের ইমামদের উক্তিও উল্লেখ্য করেছি। এরপরও যদি কেউ “উযুতে ঘাড় মাসাহ করা বিদআত” বলে দাবী করেন, তাহলে তাদের জন্য আমাদের দুআ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সুতরাং আসুন,  আমরা সকলেই তাদের জন্য হেদায়েতের দোয়া করি এবং এই দোয়া করি যে, আল্লাহ তায়ালা যেন তাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন । আমিন।

লেখক

মুফতী রেজাউল করিম

মুহাদ্দীস: সুফফাহ মাদরাসা,  মহেশপুর, ঝিনাইদহ।

You have to wait 1 minute before download link appears.
লিঙ্ক আসিতেছে...
সত্য প্রকাশ

আমার নামঃ মুফতি রেজাউল করিম। আমি একটি কওমী মাদরাসায় শিক্ষকতা করছি। পাশাপাশি এ ব্লগের সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। অনলাইন সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান থাকায় সময় পেলে দ্বীন ইসলাম নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করি। যেন অনলাইনেও মানুষ ইসলামি জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আপনিও চাইলে এ ব্লগে লিখতে পারেন। মোবাইলঃ 01782-40 91 69

Please Select Embedded Mode For Blogger Comments

নবীনতর পূর্বতন