প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের কণ্ঠে গাওয়া গজল গায়রে মাহরামদের শ্রবণ করার হুকুম কী?

শরিয়ত ইবাদতের ক্ষেত্রে মহিলাদের আওয়াজ নিচু করতে আবশ্যক করেছে। যেমন, পুরুষের নামাযের ক্ষেত্রে ইমামের নামাযে কোন সমস্যা হলে মুক্তাদি কে তাসবিহ পাঠ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর মহিলাদের কে তাসবিহ পাঠ করতে নিষেধ করা হয়েছে  যেন পুরুষ তার আওয়াজ শুনতে না পায়। শরিয়ত তাদের জন্য উভয় হস্ত দ্বারা মৃদু আওয়াজ করাকে সাব্যস্ত করেছে।



একজন নারীর রূপ সৌন্দর্য যেমন অন্যকে আকৃষ্ট করে তেমনি তার কোমল কণ্ঠ ও অন্যকে আকৃষ্ট করে। এ জন্য নারীর আওয়াজ কে ফুকাহায়ে কেরাম সতরের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। । তাই কোনো কোনো ফক্বীহ বলেছেন, মহিলাদের থেকে কুরআন শেখা থেকে অন্ধ ব্যক্তি থেকে শিক্ষা করা উত্তম। কেননা, মহিলার স্বর সতর৷ তাইতো নবী স় বলেছেন, পুরুষের জন্যে তাসবিহ আর মহিলার জন্যে তাসফিক সুতরাং পুরুষের জন্য মহিলার আওয়াজ শোনা জায়েয নেই।
সুতরাং প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে বা প্রাপ্ত বয়স্ক হবার নিকটবর্তী মেয়েদের পরপরুষের সামনে গজল গাওয়া যেমন জায়েয নেই, তেমনি গায়রে মাহরাম কারো জন্য এসব মেয়েদের গজল নাসিদ শোনাও জায়েয নয়।
চাই তা একাকি হোক বা একত্রিত ভাবে হোক৷ এবং মোবাইলে হোক বা অন্য কোন মাধ্যমে হোক।

কুরআনে বর্ণিত মেয়েদের কথা বলার পদ্ধতি

আল্লাহ তায়ালা প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে পরপুরুষের সাথে  কোমল ও আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

 يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِّنَ النِّسَاءِ ۚ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوفًا

অর্থ: হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও;যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর,তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না,ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে,যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, তারা তোমাদের প্রতি আকৃষ্ট হবে। বরং তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে। (সূরা আহযাব-৩২)
এ আয়াতে নবী পত্নীদেরকে সম্বোধন করা হলেও বিধান পৃথিবীর সকল নারীদের জন্য প্রদত্ত । উক্ত আয়াত দ্বারা পর পুরুষের সাথে অসংগতিপূর্ণ বা অপ্রয়োজনীয় কথা বলা না জায়েজ প্রমাণিত হয়.. তাই তো প্রয়োজনবশতঃ কথা বলা বৈধ থাকলেও মহিলা সাহাবীগণ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পরপুরুষের সাথে কথা বলতেন। হযরত আয়েশা (রা) এর নিকট মাসয়ালা বা হাদিসের প্রয়োজনে অন্যান্য সাহাবীগণ আসলে, তিনি মুখের ওপর হাত রেখে কণ্ঠ বিকৃত করে পর্দার আড়ালে থেকে কথা বলতেন। যেন কারো অন্তর ব্যাধিগ্রস্থ না হয় । উক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় বিনাপ্রয়োজনে পরপুরুষের সাথে কথা বলা জায়েজ হবে না । সুতরাং কথা বলা যদি নোজায়েয হয় তাহলে তাদের গজল নাসিদ শোনা আরো উত্তম ভাবে নাজায়েয হবে। কারণ, গজল নাসিদ আবৃত্তি করা হয় সুর দিয়ে । মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য। 

হাদিসে বর্ণিত মেয়েদের কথা বলার পদ্ধতি


হযরত আলী রাঃ থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসের একাংশে এসেছে,

وَاسْتَفْتَتْهُ جَارِيَةٌ شَابَّةٌ مِنْ خَثْعَمٍ، فَقَالَتْ: إِنَّ أَبِي شَيْخٌ كَبِيرٌ قَدْ أَدْرَكَتْهُ فَرِيضَةُ اللهِ فِي الحَجِّ، أَفَيُجْزِئُ أَنْ أَحُجَّ عَنْهُ؟ قَالَ: حُجِّي عَنْ أَبِيكِ. قَالَ: وَلَوَى عُنُقَ الفَضْلِ، فَقَالَ العَبَّاسُ: يَا رَسُولَ اللهِ، لِمَ لَوَيْتَ عُنُقَ ابْنِ عَمِّكَ؟ قَالَ: رَأَيْتُ شَابًّا وَشَابَّةً فَلَمْ آمَنِ الشَّيْطَانَ عَلَيْهِمَا   

অর্থাৎ এরকম সময় তাকে [রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে] খাসআম গোত্রের এক যুবতী ফাতাওয়া জিজ্ঞাসা করল, আমার বাবা খুবই বয়স্ক ব্যক্তি। আল্লাহ্ তা’আলার নির্ধারিত হজ্জ তার উপর ফরয হয়েছে। তার পক্ষ হতে আমি হজ্জ আদায় করলে সেটা কি তার জন্য যথেষ্ট হবে? তিনি বললেনঃ তোমার বাবার পক্ষ হতে হজ্জ আদায় কর। আলী (রাঃ) বলেন, তিনি এমন সময় ফাযলের ঘাড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন। আব্বাস (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার চাচাতো ভাইয়ের ঘাড় কেন ঘুরিয়ে দিলেন? তিনি বললেনঃ আমি লক্ষ্য করলাম এরা দুইজন যুবক-যুবতী। সুতরাং তাদেরকে আমি শাইতান হতে নিরাপদ মনে করিনি।
(সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-৮৮৫, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৫৬২)

প্রাপ্ত বয়স্ক   মেয়েদের কণ্ঠস্বর সতর কি না?

নাওয়াযেল কিতাবে রয়েছে,
إن صوتها عورة
অর্থাৎ নিশ্চয় প্রাপ্ত বয়স্jক মেয়েদের কণ্ঠস্বর সতর।
প্রশিদ্ধ ফতোয়ার কিতাব আল মুহিতুল বুরহানি তে রয়েছে,

   عدم جهرها بالتلبية بأن صوتها عورة
অর্থ: প্রাপ্ত বয়স্ক যুবতীর আওয়াজ সতর। তার আওয়াজ সতর হওয়ার কারণে উচ্চ স্বরে তালবিয়া পাঠ করা নিষেধ।

তবে সঠিক কথা হলো, মহিলাদের কণ্ঠ সতর নয়৷ যেমনটি শরীয়ী নুসুস দ্বারা বুঝা যায়৷ কুরআন সুন্নায় এমন কোন আয়াত বা হাদীস নেই যা দ্বারা বুঝা যায় যে, সর্বাবস্থায় ব্যাপক ভাবে তাদের কণ্ঠস্বর সতর৷  সাহাবায়ে কেরামের উপস্থিতে মহিলারা রাসূল স় এর নিকট বিভিন্ন দ্বীনী বিষয় জানতে চাইতেন তখন রাসুল নিষেধ করতেন না৷ যেমন সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে,
 أنَّ رسول الله ـ صلَّى الله عليه وسلَّم ـ قال:(يا معشر النساء تصدقن وأكثرن الاستغفار؛ فإنِّي رأيتكنَّ أكثر أهل النار ، فقالت امرأة جزلة منهنَّ: وما لنا يا رسول الله أكثر أهل النار؟ فقال: تكثرن اللعن ، وتكفرن العشير


অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে মহিলারা তোমরা বেশী বেশী সদকা ও ইসতেগফার কর৷ নিশ্চয় আমি তোমাদের অধিকাংশকে জাহান্নামে দেখেছি৷ তখন জনৈক মহিলা বলল, হে আল্লাহর রাসূল আমরা কেন অধিকংশ জাহামে যাব? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা খুব বেশী অভিসম্পাত দাও আর না শুকরি কর৷

অনুরুপ ভাবে মুসলিম শরীফের হ্দীস হযরত আনাস রা় থেকে বর্ণিত,

 قال أبو بكر لعمر - رضي الله عنهما - بعد وفاة رسول الله صلى الله عليه وسلم: انطلق بنا إلى أم أيمن - رضي الله عنها - نزورها كما كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يزورها


অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাতের পর আবু বকর রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ওমর  রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কে বললেন, চল, আমরা উম্মে আইমান  রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা এর সাক্ষাতে যাই যেমনি ভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেতেন৷
এসকল হাদীস দ্বারা বুঝা যায় প্রয়োজন অনুপাতে ফেতনার আসঙ্কা না থাকলে পুরুষের সাথে স্বাভাবিক কথা বলা জায়েয৷

গায়রে মাহরাম মহিলার গান গজল সঙ্গীত নাসিদ শ্রবণ করার হুকুমের ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের বক্তব্য।

ইমাম ইবনুল জাওযি রহমালাতুল্লাহি আইহি বলেন,


                              أما سماع الغناء من المرأة التي ليست بمحرم فإن أصحاب الشافعي قالوا : لا يجوز سواء كانت حرة أو مملوكة
قال : وقال الشافعي : وصاحب الجارية إذا جمع الناس لسماعها فهو سفيه ترد شهادته ، ثم غلَّظ القول فيه فقال : وهو دياثة

অর্থাৎ গায়রে মাহরাম মহিলার গান (গজল সঙ্গীত) শ্রবণ করার ব্যাপারে শাওয়াফিগণ বলেন, গায়রে মাহরাম মহিলার গান  শ্রবণ করা জায়েয নেই চাই সে স্বাধীন মহিলা হোক অথবা দাসী৷
তিনি বলেন, ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, যে গায়িকার মালিক গান শোনানোর জন্য লোকদের একত্রিত করে সে অজ্ঞ তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়৷
তিনি আরো কঠোর ভাষায় বলেন, সে দাইউস৷ ( তালবিসে ইবলিস,277)

ইমাম ইবনুল কাইয়্যুম রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর বক্তব্য


ইমাম ইবনুল কাইয়্যুম রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন বলেন,

" وأما سماعه – يعني الغناء عموما - من المرأة الأجنبية فمن أعظم المحرمات ، وأشدها فسادا للدين "
অর্থাৎ আজনবী মহিলার গান- গজল শ্রবণ করা সর্বাপেক্ষা হারাম কাজ এবং দ্বীনের সবচেয়ে দূষিত বিষয়৷ ( ইগাসাতুল লুহফান,1/230)

শাইখ ইবনে উছাইমিন রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর বক্তব্য

শাইখ ইবনে উছাইমিন রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

رأيي أن هذا حرام : أن تظهر أصوات النساء عند الرجال الذي يجلسون يستمعون إليهن ويتلذذون بأصواتهن " انتهى .
অর্থাৎ আমার মতামত হলো এটা হারাম যে, উপবিষ্ট পুরুষদের সম্মুখে মহিলাদের আওয়াজ উচু হবে এবং তারা তাদের আওয়াজ শ্রবণ করে স্বাদ উপভোগ করবে৷ ( আল লিকাউস সাহরী,55)

ইমাম খরাশী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর বক্তব্য

ইমাম খরাশী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

رفع صوت المرأة التي يخشى التلذذ بسماعه لا يجوز من هذه الحيثية ، لا في الجنازة ولا في الأعراس 

অর্থাৎ যে মহিলার আওয়াজ শুনে স্বাদ উপভোগ করার আশঙ্কা রয়েছে তার আওয়াজ উচু করা জায়েয নেই৷ মৃত ব্যক্তির জন্য ক্রন্দন করার ক্ষেত্রেও জায়েয নেই, এবং বিবাহের ভোজ আয়োজনেও জায়েয  নেই । ( শরহে মুখতাছার খলিল,1/276)


মুফতি রেজাউল করিম
তরুণ লেখক ও কলামিস্ট
সুফফাহ মাদরাসা, জলিলপুর মহেশপুর, ঝিনাইদহ
সত্য প্রকাশ

My name: Mufti Rezaul Karim. I am teaching in a communal madrasah, I try to write something about Deen Islam when I have time because I have a fair amount of knowledge about online. So that people can acquire Islamic knowledge online. You can also write on this blog if you want.

Please Select Embedded Mode For Blogger Comments

নবীনতর পূর্বতন