ইসলাম একটি সহজ ও উদারতার ধর্ম৷ ইসলামের উদারতা ও সহজতার একটি দৃষ্টান্ত হলো হলো, ইসলামে রয়েছে আনন্দ ও খুশি উপভোগ করার দিন ৷ তম্মধ্যে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা অন্যতম ৷ ইনশাআল্লাহ আমরা আজ এ প্রবন্ধের মাধ্যমে জানতে পারবো, কীভাবে মুসলমান ঈদ উযদযাপন করবে৷ বা ঈদের আদবগুলো কী কী?
ইসলামে ঈদ মাত্র দু'টি তৃতীয় কোনো ঈদ নেই৷
হযরত আনাস রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كان لأهل المدينة في الجاهلية يومان من كل سنة يلعبون فيهما ، فلما قدم النبي صلى الله عليه وسلم : قال : كان لكم يومان تلعبون فيهما ، وقد أبدلكم الله بهما خيرا منهما : يوم الفطر ، ويوم النحر
অর্থাৎ জাহেলী যুগে মদীনাবাসীগণ বছরে দু'দিন আনন্দ উদযাপন করত৷ অতপর যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় আগমন করলেন৷ তখন তিনি বললেন, তোমাদের বর্তমান আনন্দের দুদিন কে আল্লাহ তাআলা তার চেয়ে উত্তম দুদিন দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছেন৷ একটি হলো, ঈদুল ফিতর অন্যটি ঈদুল আযহা৷ (আবু দাউদ, হাদীস নং, ৯৭২)
উল্লিখিত হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিষ্কার ভাবে বলেছেন যে, মুসলমানদের ঈদ দু'টি- ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আযহা৷ তৃতীয় কোনো ঈদ নেই৷ সুতরা ঈদে মিলাদুন নবী, ভালোবাসা দিবস বলতে ইসলামে কিছু নেই৷ সুতরাং এ ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তার রাসূলের বিধানাবলী ফলো করা৷ সর্বপ্রকার পাপাচার ও গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকা৷
আমরা যদি নিম্নের বিষয়গুলি ফলো করি তাহলে আমরা একই সাথে ঈদ আনন্দ ও ইবাদত পালন করতে পারবো ৷ আর যদি বিষয়গুলো ফলো না করি, অনুসরন না করি, তাহলে আনন্দের সাথে আমাদের আমল নামায় যুক্ত হবে শুধু গুনাহ আর পাপাচার৷
আরো পড়ুন»সুন্নাহর আলোকে বিতর নামায তিন রাকাত
১৷ ঈদের দিন গোসল করা ও সুগন্ধি ব্যবহার করা৷
হযরত ইবনে উমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন৷
(মুয়াত্তায়ে মালেক, হাদীস নং ৪৩০)
হযরত জা'দ ইবনে আব্দুর রহমান রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন,
رأيت السائب بن يزيد يغتسل قبل أن يخرج إلى المصلى
অর্থাৎ আমি সায়েব বিন ইয়াযিদকে ঈদগাগে বের হওয়ার পূর্বে গোসল করতে দেখেছি৷
(আহকামুল ঈদাইন, হাদীস নং ১৫)
হযরত নাফে রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
أن ابن عمر رضي الله عنهما: كان يغتسل ويتطيب يوم الفطر
অর্থাৎ হযরত ইবনে উমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু ঈদুল ফিতরে গোসল করতেন ও সুগন্ধি ব্যবহার করতেন৷
(আহকামুল ঈদাইন, হাদীস নং ১৭)
২৷ ঈদগাহে এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া অন্য রাস্তা দিয়ে আসা৷
অধিকাংশ আলেমগণ বলেছেন, ঈদগাহে এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া অন্য রাস্তা দিয়ে আগমন করা মুস্তাহাব৷ হযরত আবু হুরায়রা রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كان النبي-صلى الله عليه وسلم إذا كان يوم عيد خالف الطريق
অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের দিন রাস্তা পরিবর্তন করতেন৷ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৯,৫৭)
৩৷ পরস্পর মুসলমানকে অভিবাদন জানানো৷
হযরত খালিদ ইবনে মাদান থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ঈদের দিন ওয়াসেলা বিন আসকার সাথে আমার সাক্ষাত ঘটলে আমি তাকে এভাবে অভিবাদন জানালাম,
تقبل الله منا ومنك
অতপর তিনিও বললেন,
تقبل الله منا ومنك
ওয়াসেলা বলেন, ঈদের দিন আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে সাক্ষাত করে
تقبل الله منا ومنك
বলে অভিবাদন জানালাম৷ তিনিও বললেন, হ্যা
تقبل الله منا ومنك
(তাবারানি, হাদীস নং-০১৭৯৯১)
হযরত জুবাইর ইবনে নুফাইর রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كان أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا التقوا يوم العيد يقول بعضهم لبعض: تقبل منا ومنك
অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন যখন পরস্পরে সাক্ষাত করতেন তখন
تقبل الله منا ومنك
বলতেন৷ (ফাতহুল বারি, হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী)
তিনি এ হাদীসকে হাসান বলেছেন৷
তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম অর্থ
তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম এর অর্থ হলো,আল্লাহ তায়ালা আমাদের ও আপনাদের ইবাদাতগুলো কবুল করুন৷
ঈদ মোবারক অর্থ কি? ও তা বলার বিধান কি?
ঈদ মোবারক অর্থ হলো, I wish a happy holiday for you
অর্থাৎ আপনার ছুটির দিনটি শুভ হোক৷
দুআ হিসেবে 'ঈদ মোবারক' বলা জায়েয আছে৷ তবে সুন্নত হিসেবে বললে তা বিদআত হবে৷ কারণ, তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়৷ তবে تقبل الله منا ومنك বলাটাই উত্তম৷ কারণ তা হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত৷
"ঈদ মোবারাক" বলা জায়েয কিনা ? এই বিষয়ে সৌদির শায়েখ বিন বায রহিমাহুল্লাহ কে প্রশ্ন করা হলে,
তিনি উত্তরে বলেন,
ﻟﻴﺲ ﻟﻬﺬﺍ ﺻﻴﻐﺔ ﻣﻌﺮﻭﻓﺔ، ﻓﺈﺫﺍ ﺩﻋﺎ ﻟﻪ ﻗﺎﻝ : ﺗﻘﺒﻞ ﺍﻟﻠﻪ ﻣﻨﺎ ﻭﻣﻨﻚ، ﺃﻭ ﻋﻴﺪﻛﻢ ﻣﺒﺎﺭﻙ، ﺃﻭ ﺍﻟﻌﻴﺪ ﻣﺒﺎﺭﻙ، ﺃﻭ ﺟﻌﻞ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻴﺪﻛﻢ ﻣﺒﺎﺭﻙ، ﺳﻮﺍﺀ ﻛﺎﻥ ﻋﻴﺪ ﺍﻷﺿﺤﻰ، ﺃﻭ ﻋﻴﺪ ﺍﻟﻔﻄﺮ
অর্থাৎ ‘‘এ ব্যাপারে কোনো নির্দিষ্ট শব্দ নেই।। তার জন্য দুআ করে বলা যেতে পারে, "তাকাবাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা" অথবা "ঈদুকুম মুবারক" অথবা "আল ঈদ মুবারক" অথবা "জা'আলাল্লাহু ঈদুকুম মুবারক"।। চাই ঈদুল আযহা হোক না কেন? অথবা ঈদুল ফিতর।।’’
৩৷ ঈদের দিন বেশি বেশি তাকবির পাঠ করা
তাকবির হলো ঈদের দিনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত আমল৷ আল্লাহ তাআলা বলেন,
ولتكملوا العدة ولتكبروا الله على ما هداكم ولعلكم تشكرون
অর্থাৎ তোমাদেরকে পথ দেখানোর জন্য তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো, আর যেন তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো৷ (আল-বাক্বারাহ ১৮৫)
আরো পড়ুন» বিতর নামায আদায়ের পদ্ধতি
তাশরীক শব্দের অর্থ কি? ও তাকবীরে তাশরীক পাঠের সময় কখন?
তাশরীক একটি আরবি শব্দ৷ এর অনেক অর্থ রয়েছে৷ তম্মধ্যে,পূর্বমুখীকরণ, গোশত রৌদ্রে শুষ্ককরণ অন্যতম৷
ঈদুল ফিতরে তাকবীর পাঠের সময় হলো, জমহুর আলেমগণের মতে নামাযে যাওয়ার জন্য বের হওয়া থেকে খুতবার পূর্ব পর্যন্ত৷
আর ঈদুল আযহার তাকবীরের সময় হলো, ৯ ই জিলহজ্ব ফজরের পর থেকে ১৩ ই জিলহজ্ব আসর পর্যন্ত৷ মোট তেইশ ওয়াক্ত নামাযের শেষে৷
৪৷ ঈদের দিনে খাওয়া
কোরবানির ঈদে নামাজের পূর্বে কিছু না খাওয়া মুস্তাহাব। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল আজহার দিন কিছুই খেতেন না, যে পর্যন্ত ঈদের নামাজ আদায় করতেন।
(তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)
হযরত মুসাইয়্যাব রহিমাহুল্লাহ বলেন,
كان المسلمون يأكلون يوم الفطر قبل الصلاة ، ولا يفعلون ذلك يوم النحر
অর্থাৎ মুসলমানগণ ঈদুল ফিতরে নামাযের পূর্বে খেতেন তবে ঈদুল আযহায় এমনটি করতেন না৷ অর্থা ঈদুল আযহায় নামাযের পরে পশু জবাইয়ের পরে খেতেন৷
(সুনানুল কুবরা লিল বাইহাকী, হাদীস নং ৫৭৬৩)
৫৷ ঈদের নামাযের পূর্বে পরে কোনো সুন্নত না পড়া
হযরত ইবনে আব্বাস রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أن رسول الله صلى الله عليه وسلم خرج في يوم عيد أضحى ، فلم يصل قبلها ولا بعدها
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল আযহার দিন নামাযের জন্য বের হতেন কিন্তু নামাযের পূর্বে পরে কোনো নামায পড়তেন না৷
(আহকামুল ঈদাইন, হাদীস নং ১৪৩)
৬৷ দুই ঈদের দিন রোযা রাখা হারাম৷
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى عَنْ صِيَامِ يَوْمَيْنِ يَوْمِ الْفِطْرِ وَيَوْمِ النَّحْرِ
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহায রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন৷
(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮২৭)
৭৷ ঈদের দিন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও উত্তম পোষাক পরিধান করা৷
হযরত জাবের রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন,
كان للنبي صلى الله عليه وسلم جبة يلبسها للعيدين ويوم الجمعة
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি জুব্বা ছিলো যা তিনি দুই ঈদ ও জুমআর দিন পরিধান করতেন৷ (সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস নং ১৭৬৫)
আরো পড়ুন» কুরবানির পশু যবাইয়ের শরয়ী বিধান
ইমাম বাইহাকী রাহিমাহুল্লাহ সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন যে,
أن ابن عمر كان يلبس للعيد أجمل ثيابه
অর্থাৎ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু ঈদের দিন সর্বাপেক্ষা সুন্দর কাপড়টি পরিধান করতেন৷
সুতরাং প্রত্যেকের উচিত ঈদের নামাযে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিধান করে ঈদগাহে যাওয়া ৷
মুফতি রেজাউল করিম যশোরী: লেখক ও গবেষক
মুহাদ্দিস, সুফফাহ মাদরাসা, মহেশপুর, ঝিনাইদহ
লেখা আহবান
প্রিয় পাঠক, সমকালীন প্রসঙ্গ নিয়ে আপনার বিশ্লেষণমূলক রচনা পাঠিয়ে দিন আমাদের কাছে। লেখা পাঠানোর জন্য ব্যবহার করুন ই-মেইল ঠিকানা rezua1995@gmail.com