আল্লাহর নৈকট্য, আত্মত্যাগ, আত্মোৎসর্গের সুমহান মহিমায় ভাস্বর এই কুরবানী।মহান স্রষ্টা আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা-বিশ্বাস ও জীবনের সর্বস্ব উৎসর্গের মাধ্যমে তার নৈকট্য লাভের বার্তা নিয়ে এ দিনটি প্রতি বছর মুসলিম জাতির নিকট উপস্থিত হয়।কুরবানি ঈমানদারদের (বিশ্বাসী) জীবনের এক তাৎপর্যপূর্ণ গৌরবের উৎস এবং অনন্য ইবাদত। মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার একান্ত অনুগত পুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহি ওয়া সাল্লামের আত্মত্যাগের স্মৃতি বিজড়িত ইবাদত ও মহান রবের নৈকট্য লাভের অনুষ্ঠান-ই হলো কুরবানী। তাই তো আমরা আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা-ভরসা ও পশু উৎসর্গের (কুরবানীর) মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভে সচেষ্ট হই।আর এই উৎসর্গ (কুরবানী)অবশ্যই আল্লাহ তাআলার নির্দেশিত পথ ও পন্থায় হতে হবে। তাই আসুন জেনে নেই কুরবানীর পশু জবেহ করার শরয়ী বিধান।
১. মাসআলা : কুরবানীর নিয়ত শুধু কুরবানীদাতার জন্য মনে মনে করাই যথেষ্ট হবে৷ জবাইকারীর জন্য নামের লিষ্ট পড়ারও কোন প্রয়োজন নেই। তা পরিহার করা উচিত৷ (আল-ফিকহুল ইসলামী ৪/৩০০)
২. মাসআলা : কুুরবানীর পশু নিজে জবাই করা উত্তম, তবে নিজে ভালো ভাবে না পারলে,অন্য কোন দ্বীনদার ব্যক্তিদ্বারা জবাই করাবে। আর জবাহের সময় নিজে উপস্থিত থাকবে৷ মহিলাদের পর্দার বেঘাত হলে উপস্থিত থাকার প্রয়োজন নেই৷ তবে এ ক্ষেত্রে জবেহ কারীকে পারিশ্রমিক দিয়ে দিবে৷ কিন্তু কুরবানীর গোশত দ্বারা পারিশ্রমিক দেওয়া জায়েয হবে না৷(ফতোয়ায়ে শামী ৫/২০৮)
৩. মাসআলা : কুরবানীর পশুকে দক্ষিন দিকে মাথা দিয়ে কেবলা মুখি করে শুয়ানো সুন্নাত। অতঃপর এ-দুআটি পাঠ করা মুস্তাহাব -ﺇِﻧِّﻲ ﻭَﺟَّﻬْﺖُ ﻭَﺟْﻬِﻲَ ﻟِﻠَّﺬِﻱ ﻓَﻄَﺮَ ﺍﻟﺴَّﻤَﺎﻭَﺍﺕِ ﻭَﺍﻟْﺄَﺭْﺽَ ﺣَﻨِﻴﻔﺎً ﻭَﻣَﺎ ﺃَﻧَﺎ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻤُﺸْﺮِﻛِﻴﻦَ . ﺇِﻥَّ ﺻَﻼﺗِﻲ ﻭَﻧُﺴُﻜِﻲ ﻭَﻣَﺤْﻴَﺎﻱَ ﻭَﻣَﻤَﺎﺗِﻲ ﻟِﻠَّﻪِ ﺭَﺏِّ ﺍﻟْﻌَﺎﻟَﻤِﻴﻦَ ﻻ ﺷَﺮِﻳﻚَ ﻟَﻪُ ﻭَﺑِﺬَﻟِﻚَ ﺃُﻣِﺮْﺕُ ﻭَﺃَﻧَﺎ ﺃَﻭَّﻝُ ﺍﻟْﻤُﺴْﻠِﻤِﻴﻦَ "(মিশকাত শরীফ ১২৮)তারপর “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বলে জবাই করা ওয়াজিব। ইচ্ছাকৃতভাবে বিসমিল্লাহ তরক করলে,কুরবানী সহীহ হবেনা এবং এর গোশত খাওয়াও হালাল হবেনা৷ তবে ভুলে বিসমিল্লাহ ছুটে গেলে কোন অসুবিধা হবে না। (জাওয়াহিরুল ফিকাহ ১/৪৫০)
৪. মাসআলা : জবাইকারীর জন্য বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে জবাই করা ওয়াজিব৷ যিনি জবাই কাজে সাহায্য করবে,তার জন্যও বিমমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলা ওয়াজিব৷ জবাইকারীর যদি কোন একজন ইচছাকৃতভাবে বিসমিল্লাহ না পড়ে,তবে কুরবানী সহীহ হবেনা। উক্ত পশুর গোশত খাওয়াও হালাল হবেনা। তবে যারা পশু ধরবে তাদের জন্য বিসমিল্লাহ বলা ওয়াজিব নয়৷ বরং মুস্তাহাব৷(ইমদাদুল ফতোয়া ৩/৫৪০)
৫. মাসআলা : জবাইয়ে একাধিক ব্যক্তি শরীক হলে, অনেক সময় জবাইকারীর জবাই সম্পন্ন হয় না, তখন কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্যই উভয়কেই নিজ নিজ যবাইয়ের আগে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে। যদি কোনো একজন না পড়ে তবে ওই কুরবানী সহীহ হবে না এবং জবাইকৃত পশুও হালাল হবে না। [রদ্দুল মুহতার ৬/৩৩৪]
৬. মাসআলা : হলক্ব ও কন্ঠের মধ্যখানে পশু জবাই করবে৷ জবাইয়ের মধ্যে চারটি রগ কাটা ওয়াজিব৷ ১৷ খাদ্যনালী ৷ ২৷ শ্বাসনালী ৷
৩, ৪৷দুটি শাহ রগ।(হলকুম,মরি,অদজান,অজীন)এ চারটি রগের মধ্য হতে যদি তিনটিও কাটে,তবে কুরবানী সহীহ হবে৷ অন্যথায় কুরবানী সহীহ হবেনা এবং এর গোশত খাওয়াও হালাল হবেনা।(ইমদাদুল ফতোয়া ৩/৫৩৭)
৭. মাসআলা :৮. মাসআলা : জবাইয়ের পর পশুর জান বের হবার পূর্বে চামড়া ছোলা,রগ কাটা,ছুরি দিয়ে গলার হাড্ডিতে আঘাত করা বা অন্য কোন অঙ্গ কাটা,মাকরূহে তাহরীমী। সুতরাং তা পরিহার করা উচিত৷ (ফতোয়ায়ে কাসেমীয়া ১/৩৬০)※ এক পশুর সামনে অন্য পশু জবাই করা মাকরুহ৷ এবং ভোতা ছুরি দ্বারা জবাই করাও মাকরুহ৷ সুতরাং ছুড়ি খুব ধারালো হওয়া জরুরী৷(ইমদাদুল ফতোয়া ৩/৫৪৭)কুরবানী পশু জবাই করে পারিশ্রমিক দেওয়া-নেওয়া জায়েয। তবে কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া যাবে না। -কিফায়াতুল মুফতী ৮/২৬৫
১০. মাসআলা : কসাই,জবাইকারী ও গোশত কাটার কাজে সাহায্যকারীকে চামড়া,গোশত,পায়া বা কুরবানীর পশুর অন্য কোন অংশ পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েয হবে না। কেউ দিলে তার মূল্য সদকাহ করে দেওয়া ওয়াজিব হবে৷ তবে পূর্ন পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্বচুক্তি ব্যতীত গোশত বা পশুর অন্য কোন অংশ দেওয়া জায়েয হবে৷ (ফতোয়ায়ে কাযীখান ৩/৩৫৪)
১১. মাসআলা : কুরবানীদাতা এক স্থানে আর কুরবানীর পশু ভিন্ন স্থানে থাকলে কুরবানীদাতার ঈদের নামায পড়া বা না পড়া ধর্তব্য নয়; বরং পশু যে এলাকায় আছে ওই এলাকায় ঈদের জামাত হয়ে গেলে পশু জবাই করা যাবে। -আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৮
১২. মাসআলা : কুরবানীর দিনে মোরগ জবাই করা নিষেধ নয়, তবে কুরবানীর নিয়তে করা যাবে না। -খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১৪, ফাতাওয়া বাযযাযিয়া ৬/২৯০, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২০০)আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর নির্দেশিত পন্থায় পশু জবেহ করে তাঁর আনুগত্য প্রকা এবং নৈকট্য লাভের তাওফিক দিক। আমীন।
অতিথি লেখক:
মুফতি মাহমুদ হাসান
দারুল হাদীস (এম.এ,ইসলামিক স্টাডিস)
জামিয়াতুল আবরার বসুন্ধরা ঢাকা।
আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ(অনার্স) ঢাকা।
দারুল ইফতা (ইসলামিক আইন ও গবেষণা বিভাগ) ঢাকা।