মুফতি রেজাউল করিম |
প্রিয় ভিজিটর! আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগতম৷ আজ আপনাকে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও শরয়ী দলীল সমৃদ্ধ আর্টিকেল বা প্রবন্ধ উপহার দেয়ার চেষ্টা করবো৷ প্রবন্ধের শিরোনাম বা টাইটেল হলো, সহীহ হাদীসের আলোকে শবে বরাতের ফজিলত ও আমল৷
এ শিরোনামে নাম করা পত্র পত্রিকা ও ব্লগে অনেক প্রবন্ধ পাবলিশ করা হয়েছে৷ যা গুগল সার্চ ইঞ্জিনের ফার্স্ট পেজ স্থান করে নিয়েছে৷ যা আপনি হয়তো পড়েছেন৷ আশা করি আমার এ প্রবন্ধটি পাঠ করার পর অন্য সব প্রবন্ধের সাথে এ প্রবন্ধের পার্থক্য আনুমান করতে পারবেন৷
যাই হোক, শবে বরাতের ফজিলত ও আমল প্রমাণিত কি না? এ নিয়ে রয়েছে আমাদের সমাজে এক দলের বাড়াবাড়ি৷ আর এক দলের ছাড়াছাড়ি৷ বাড়াবাড়ির অর্থ হলো, কিছু মানুষ সহীহ আমলের সাথে মন গড়া ইবাদতও করতে থাকে৷ যা অবশ্যই পরিত্যাজ্জ৷ আর ছাড়াছাড়ির অর্থ হলো, শবে বরাত বলতে ক্ছুই নেই ৷ আমি আলোচনা করবো মধ্যম পন্থায় থেকে ইনশাআল্লাহ৷
শবে বরাত কবে ২০২১
শাবান মাস আগমন করার সাথে সাথে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ খুঁজতে থাকে শবে বরাত ৷ সবাই মোবাইল বা ল্যাপটপের মাধ্যমে বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ দেয়, শবে বরাত কবে ২০২১? এ বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে শবে বরাত হলো, ২৯ মার্চ দিবাগত রাত্রে৷
শবে বরাত অর্থ কি?
শবে বরাত দু'টি ফার্সি শব্দের সমষ্টি৷ শব অর্থ রাত৷ আর বরাত অর্থ মুক্তি৷ সুতরাং শবে বরাতের অর্থ হলো, মুক্তির রজনী৷ এ শব্দ কুরআন হাদীসে নেই৷ হাদীসের ভাষায় এ রজনীকে বলা হয়, লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান৷
শাবান মাসের ১৫ তম রাতকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়। নামকরণগুলো দুটি বিষয়ের ভিত্তিতে হয়ে থাকেঃ
মধ্য শাবান বা অর্ধ শাবান, ইসলামী দিনপঞ্জির অষ্টম মাস শাবান মাসে দিনটির অবস্থান অনুসারে নামকরণ। ইরান ও আফগানিস্তানে নিম শা'বান।
আরবী ভাষাভাষীগণ বলেন, নিসফ্ শা'বান। মালয় ভাষাভাষীগণ বলেন, নিসফু শা'বান। তুর্কি ভাষাভাষীগণ বলেন, বিরাত কান্দিলি। ভারতীয় উপমহাদেশে বলা হয় শবে বরাত, নিফসু শাবান ইত্যাদি।
আরোও পড়ুন→SEO ফ্রেন্ডলি আর্টিকেল কিভাবে লিখবেন
শবে বরাত সম্পর্কে কোরআনের আয়াত
সঠিক ও বিশুদ্ধ কথা হলো, লাইলাতুন নিসফি মিন শা'বান বা শবে বরাতের ফযিলত বা তা প্রমাণিত হওয়ার ব্যাপারে কোনো আয়াত কুরআনুল কারীমে নেই ৷ শবে বরাতের ফযিলত ও তা শরীয়ত সম্মত হওয়া সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত ৷
তবে কোনো কোনো মুফাসসিরগণ সূরা দুখানের এই →إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ আয়াতে উল্লিখিত لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ ( বরকতময় রজনী) কে শবে বরাতের রজনী বলে মত প্রকাশ করেছেন৷ কিন্তু তাদের এ মতকে খন্ডন করে হাফেয ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ তার বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থে বলেন, لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ দ্বারা উদ্দ্যেশ্য হলো, লাইলাতুল কদর ৷
কেননা, আল্লাহ তাআলা সূরাতুল কদরে বলেছেন,
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ
অর্থঃ আমি কদর রজনীতে কুরআন নাযিল করেছি৷
আর আমরা সবাই জানি যে, লাইলাতুল কদর পবিত্র রমযান মাসে৷ সুতরাং لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, লাইলাতুল কদর৷ শবে বরাত নয়৷ (তাফসিরে ইবনে কাসীর)
শবে বরাতের ফজিলত
শবে বরাত অর্থাৎ পনেরো শা’বানের রাত্রের ফজিলত সম্পর্কে সহীহ হাদীস রয়েছে। এ রজনীর ফজিলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত৷ হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
يطلع الله إلى خلقه في ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن.
অর্থঃ আল্লাহ তাআলা অর্ধ শা’বানের রাতে (শা’বানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতিত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
(সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস : ৫৬৬৫)
শায়খ আলবানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এ হাদিসটিকে হাসান বলেছেন।
উল্লিখিত হাদীসে মুশরিক দ্বারা উদ্দ্যেশ্য হলো, যে ব্যক্তি আল্লাহর সত্তার সাথে বা আল্লাহর গুণাবলীর সাথে অথবা ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করে৷
ইমাম আওযায়ী রহিমাহুল্লাহ বলেন, উল্লিখিত হাদীসে মুশাহিন দ্বারা উদ্দ্যেশ্য হলো,
صاحب البدعة المفارق لجماعة الأمة
অর্থঃ বিদআত কাজে লিপ্ত ব্যক্তি যে উম্মাহর দল থেকে বিচ্ছিন্ন৷
আরোও পড়ুন→ বিতর নামায কত রাকাত?
শবে বরাতের নফল নামাজ ও ইবাদত
পাড়া গাঁয়ে দেখা যায় যে, তারা এ রজনীতে এশার নামায আদায়ের পর ১২ রাকাত নামায পড়ে বাড়ি চলে যায়৷ পাঠক, মূলত এ রাতের জন্য নির্দিষ্ট কোনো ইবাদত ও নির্দিষ্ট কোনো রাকাত সংখ্যা নির্ধারিত নেই ৷ অনেক অনির্ভরযোগ্য কিতাবে বিশেষ পদ্ধতির সালাতের কথা পাওয়া যায় যা সম্পূর্ণ ভুল৷
বরং এ রাতে নফল নামায, কুরআন তেলাওয়াত, তাসবীহ তাহলীল, যিকির আযকারে লিপ্ত থাকা করণীয়৷ এ ছাড়াও যাবতীয় নফল ইবাদত এ রাতে করা যেতে পারে৷
মধ্য শাবানের নফল রোজা
শা’বানের এক তারিখ থেকে সাতাইশ তারিখ পর্যন্ত রোযা রাখার বিশেষ ফযীলতের কথা হাদীস শরীফে আছে। তাছাড়া আইয়ামে বীয তথা প্রতি মাসের তেরো, চৌদ্দ ও পনেরো তারিখে রোযা রাখার ব্যাপারে হাদীস শরীফে উৎসাহিত করা হয়েছে। সেই সাথে যয়ীফ সনদে বর্ণিত একটি হাদীসে বিশেষভাবে পনেরো তারিখের রোযা রাখার নির্দেশনাও পাওয়া যায়।
হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، فَقُومُوا لَيْلَهَا وَصُومُوا نَهَارَهَا
অর্থঃ পনেরো শা’বানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা তা ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং পরদিন রোযা রাখ।
(সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস : ১৩৮৪)
তা ছাড়া আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাবান মাসে অধিক রোযা রাখতেন৷ সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে,
كَانَ يَصُومُ شَعْبَانَ كُلَّهُ
অর্থঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাবান পূর্ণ শাবান মাস রোযা রাখতেন৷
উল্লিখিত হাদীসে 'পূর্ণ শাবান' দ্বারা উদ্দ্যেশ্য হলো, শাবান মাসের অধিকাংশ দিন৷ তা ছাড়া 'আইয়্যাম বীয' এর রোযা রাখা মুস্তাহাব৷ আইয়্যাম বীযের রোযা হলো, প্রত্যেক চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ও ১৫ তারিখে রোযা রাখা৷ হযরত আবু যর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إذا صمت شيئاً من الشهر فصم ثلاث عشرة وأربع عشرة وخمس عشرة
অর্থঃ তুমি যদি কোনো মাসে রোযা রাখ তাহলে ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রাখবে৷ (তিরমিযি, ৭৬১)
সুতরাং কেউ যদি শবে বরাতের পরের দিন রোযা রাখে তাহলে কোনো সমস্যা নেই৷ সে নফল রোযার সওয়াব পাবে৷
শবে বরাত ও হালুয়া-রুটি
গ্রাম গঞ্জে দেখা যায়, শবে বরাত কে কেন্দ্র করে দিনের বেলা হালুয়া রুটি বানানোর ধুম পড়ে যায়৷ সারা বিকেল হালুয়া রুটি বানিয়ে পাড়ার সকল বাড়িতে বাড়িতে বিলি করে৷ এটাকে তারা বিশাল ইবাদত ও নেকির কাজ মনে করে৷ মনে রাখতে হবে, শবে বরাতের সাথে হালুয়া রুটির কোনো সম্পর্ক নেই৷ এটা মানুষের বানানো প্রচলন ও রীতি৷ সুতরাং এর থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক৷
শবে বরাতে করণীয় ও বর্জনীয়
শবে বরাত উপলক্ষে নফল রোজা রাখা, নফল নামাজ পড়া, কিরাত ও রুকু-সিজদা দীর্ঘ করা; কোরআন তিলাওয়াত করা; দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া; ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা; দোয়া-কালাম, তাসবিহ তাহলিল, জিকির-আসকার ইত্যাদি করা৷
নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সব মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করা।
আরোও পড়ুন→রজব মাসের ফজিলত ও আমল
শবে বরাতে করা উচিত নয়
মসজিদ কে সুসজ্জিত করা, দোয়ার মাহফিলের আয়োজন করা, মসজিদে খিচুরী রান্না করা, মিলাদ মাহফিলের ব্যবস্থা ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকা৷
আতশবাজি, পটকা ফোটানো, ইবাদত-বন্দেগি বাদ দিয়ে খামাখা ঘোরাঘুরি করা, অযাচিত আনন্দ-উল্লাস করা, বেহুদা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ করা, অন্য কারও ইবাদতের বা ঘুমের বিঘ্ন ঘটানো, হালুয়া-রুটি বা খাবারদাবারের পেছনে বেশি সময় নষ্ট করা, ইবাদতে উদাসীনতা সমীচীন নয়।
আল্লাহ তাআলা আমাদের কে সঠিক ভাবে বোঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন৷ আমীন৷
লেখকঃ মুফতি রেজাউল করিম, মুহাদ্দীস, সুফফাহ মাদরাসা, মহেশপুর, ঝিনাইদহ