সদকাতুল ফিতর এর অর্থঃ ফিতরা (فطرة) আরবী শব্দ, যা ইসলামে যাকাতুল ফিতর (ফিতরের যাকাত) বা সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরের সদকা) নামে পরিচিত। ফিতর বা ফাতুর বলতে সকালের খাদ্যদ্রব্য বোঝানো হয় যা দ্বারা রোজাদারগণ রোজা ভঙ্গ করেন। [আল মুজাম আল ওয়াসিত- ৬৯৪]
যাকাতুল ফিতর বলা হয় ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরীব দুঃস্থদের মাঝে রোজাদারদের বিতরণ করা দানকে। রোজা বা উপবাস পালনের পর সন্ধ্যায় ইফতার বা সকালের খাদ্য গ্রহণ করা হয়। সেজন্য রমজান মাস শেষে এই দানকে যাকাতুল ফিতর বা সকালের আহারের যাকাত বলা হয়। [ফাতহুল বারী ৩/৪৬
আরোও পড়ুনঃ ইফতারের সহীহ দোয়া ও মতিউর রহমানের মিথ্যাচার
সদকাতুল ফিতর এর ফযিলত
সদকায়ে ফিতর কার উপর ওয়াজিব হবে?
ঈদের দিন সুবহে সাদেকের সময় যার কাছে যাকাত ওয়াজিব হওয়া পরিমাণ অর্থাৎ, অত্যাবশ্যকীয় আসবাব সামগ্রী ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, বাসগৃহ ইত্যাদি বাদ দিয়ে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সমমূল্য পরিমান সম্পদ থাকে তার উপর সাদকায়ে ফিতর দেয়া ওয়াজিব। উল্লেখ্য, যাকাতের মত এখানে এক বছর তার ঐ মাল অতিক্রান্ত হওয়া জরুরী নয়, বরং শুধু ঈদের দিনে মালিক থাকলে ফিতরা ওয়াজিব হবে।
ফিতরা নির্ধারণের রহস্য
ইসলাম মানবতাবাদী ধর্ম। সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার শিক্ষা প্রদান করে। ধনী-গরিব সকলে যেন ঈদ উৎসবে সমানভাবে আনন্দ উপভোগ করতে পারে সেজন্য এই সাদাকাতুল ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফিতরা মূলত রোজার জাকাত। জাকাত যেমন মালকে পবিত্র করে, ঠিক তেমনি ফিতরাও রোজাকে পবিত্র করে।
অনুবাদঃ রাসূল (সা.) সদকায়ে ফিতর নির্ধারণ করেছেন রোজাকে অনর্থক কথা ও অশ্লীল ব্যবহার হতে পবিত্র করার এবং গরিবের মুখে অন্ন দেওয়ার জন্য। [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১৬০৯] ওয়াকি ইবনুল জাররাহরা বলেন, সিজদায়ে সাহু যেমন নামাজের ক্ষতিপূরণ, তেমনি সাদাকাতুল ফিতর রোজার ক্ষতিপূরণ।
সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ
ইবনে ওমর (রা.) বলেন,
ইবনে আব্বাস (রা.) একবার রমজানের শেষ দিকে বসরায় খুতবা প্রদান করেন। সেখানে তিনি বলেন, তোমাদের রোজার সদকা আদায় করো। লোকেরা যেন ব্যাপারটা বুঝতে পারে নি।
তখন ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, এখানে মদিনার কে আছে দাঁড়াও। তোমাদের ভাইদেরকে বলো, তারা তো জানে না। বলো যে, রাসূল (সা.) এই সদকা আবশ্যক করেছেন। এক সা খেজুর বা যব অথবা আধা সা গম প্রত্যেক স্বাধীন-দাস, পুরুষ-নারী, ছোট-বড় সবার ওপর ওয়াজিব। (আবু দাউদ: ১৬২২)।
এক স' এর পরিমাণ
সাদকাতুল ফিতরের পাঁচ দ্রব্যসামগ্রীর পরিমাণ ও মূল্য তালিকা
(১)গম বা আটা দিয়ে ফিতরাঃ আটা বা গমের ক্ষেত্রে অর্ধ সা’। যার সমপরিমাণ ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম। এর বাজার মূল্যে ৭০ টাকা ফিতরা দিতে হবে।
(২) যব দিয়ে ফিতরাঃ যবের ক্ষেত্রে এক সা’। যার পরিমাণ ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম। এর বাজার মূল্য ২৭০ টাকা ফিতরা দিতে হবে।
(৩) কিসমিস দিয়ে ফিতরাঃ কিসমিসের ক্ষেত্রেও এক সা’। যার পরিমাণ ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম। এ পরিমাণ কিসমিসের বাজার মূল্য ১ হাজার ৫০০ টাকা ফিতরা দিতে হবে।
(৪) খেজুর দিয়ে ফিতরাল খেজুরের ক্ষেত্রে ১ সা’ ফিতরা দিতে হবে। যার পরিমাণ ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম। মোটামুটি মানসম্পন্ন এ পরিমাণ খেজুরের বাজার মূল্য ১ হাজার ৬৫০ টাকা ফিতরা দিতে হবে।
(৫) পনির দিয়ে ফিতরাঃ পনিরের ক্ষেত্রেও ১ সা’ ফিতরা দিতে হবে। যার পরিমাণ ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম। পনিরের বাজার মূল্য ২ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করতে হবে।
হাদীসে এ ৫টি দ্রব্যের যেকোনোটি দ্বারা ফিতরা আদায়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে যেন মুসলমানগণ নিজ নিজ সামর্থ্য ও সুবিধা অনুযায়ী এর যেকোনো ১টি দ্বারা তা আদায় করতে পারে। এখন লক্ষণীয় বিষয় হল, সকল শ্রেণীর লোক যদি সবচেয়ে নিম্ন মূল্য-মানের দ্রব্য দিয়েই নিয়মিত সদকা ফিতর আদায় করে তবে হাদীসে বর্ণিত অন্য চারটি দ্রব্যের হিসেবে ফিতরা আদায়ের উপর আমল করবে কে?
আসলে এক্ষেত্রে হওয়া উচিত ছিল এমন যে, যে ব্যক্তি উন্নতমানের আজওয়া খেজুরের হিসাবে সদকা ফিতর আদায় করার সামর্থ্য রাখে সে তা দিয়েই আদায় করবে। যার সাধ্য পনিরের হিসাবে দেওয়ার সে তাই দিবে। এর চেয়ে কম আয়ের লোকেরা খেজুর বা কিসমিসের হিসাব গ্রহণ করতে পারে। আর যার জন্য এগুলোর হিসাবে দেওয়া কঠিন সে আদায় করবে গম দ্বারা। এটিই্ উত্তম নিয়ম। এ নিয়মই ছিল নবী, সাহাবা-তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনের স্বর্ণযুগে।
এ পর্যন্ত কোথাও দুর্বল সূত্রে একটি প্রমাণ মেলেনি যে, স্বর্ণযুগের কোনো সময়ে সব শ্রেণীর সম্পদশালী সর্বনিম্ন মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা ফিতর আদায় করেছেন। তাছাড়া সর্বোৎকৃষ্ট ও মূল্যমান সবচেয়ে বেশি এমন জিনিষ দান করাই উত্তম ৷ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বোত্তম দান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ইরশাদ করেন-
أغلاها ثمنا وأنفسها عند أهلها
সদকাতুল ফিতর কাদেরকে প্রদান করা যাবে?
৩. জাকাতের জন্য নিয়োজিত কর্মচারী: যারা ইসলামী হুকুমতের পক্ষ থেকে জাকাত উসুল এবং তা বন্টন করার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত তাদেরকে জাকাত প্রদান করা যাবে। তাদের আপন পদমর্যাদা অনুপাতে জাকাতের অর্থ প্রদান করা জায়েজ, যদিও তারা ধনী হয়।
তবে ব্যক্তিগতভাবে যদি কেউ কোন লোককে জাকাত সংক্রান্ত কাজে নিয়োগ করে, তাকে জাকাতের কোন অংশ দেয়া যাবে না। নিয়োগকারী নিজের পক্ষ থেকেই তাকে বেতন দিবে। এখানে একটি প্রশ্ন আসে যে, বর্তমানে আমাদের সমাজে জাকাত উসুলকারীকে জাকাত থেকে কমিশনের ভিত্তিতে টাকা দেয়া জায়েজ কিনা? আর জাকাত উসুলকারীর যাতায়াত খরচ জাকাত থেকে গ্রহণ করা বৈধ কিনা?
এর জবাব হলো, যেহেতু বর্তমানে জাকাত উসুলকারীরা শরয়তসম্মত আমেল নয় (কারণ শরয়তসম্মত আমেল হবার জন্য ইসলামী রাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত আমেল হওয়া জরুরি) তাই তাকে জাকাত থেকে পারিশ্রমিক দিলে জাকাত আদায় হবে না। তবে সে যদি গরিব হয় আর তাকে জেনারেল ফান্ড থেকে দেয়া বেতন ছাড়া জাকাতের মাল থেকেও কিছু প্রদান করা হয় তবে তা জায়েজ।
জাকাতের টাকা নির্ধারিত হকদারের কাছে পৌঁছানোর পূর্বে তা থেকে খরচ করা বৈধ নয়। যেহেতু জাকাত আদায় হবার জন্য ‘তামলিক’ তথা গরীবকে মালিক বানিয়ে দেয়া শর্ত, আর রাস্তার খরচ জাকাতের সম্পদ থেকে গ্রহণ করা হলে খরচকৃত সম্পদে নির্ধারিত হকদারকে মালিক বানানো হয় না, তাই জাকাতের যেই অংশ রাস্তার খরচ বাবত কাটা হবে তাতে জাকাত আদায় হবেনা। তবে জেনারেল ফান্ড থেকে কালেকশনকারীর খরচ বহন করা জায়েজ আছে।
[ইযাহুননাওয়াদির-২/২২৯-২৩২,ফাতওয়ায়ে শামী-৩/২৯১,২৮৬, হেদায়া-৩/২৭৭]
৪. মন জয় করার উদ্দেশ্যে: সদ্য মুসলমান হওয়া ব্যক্তির সমস্যা দূরকরণে এবং ইসলামের ওপর অবিচল রাখার উদ্দেশ্যে তাদের জাকাত দেয়া যাবে।
৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি: যে ব্যক্তি এমন ঋণগ্রস্ত যে, ঋণ পরিশোধ করার পর তার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে না তাকে জাকাত দিয়ে সাহায্য করা যাবে।