একুশে ফেব্রুয়ারি ও ভাষাচর্চায় আমাদের উদাসীনতা
আমাদের স্কুলের মাস্টার সাহেবও "মাষ্টার" লেখেন৷ যারা ফটোস্ট্যাট করেন তাদের কথা বাদই দিলাম৷ তারা লেখেন "ফটোষ্ট্যাট"৷
রেলস্টেশনে দেখবেন বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে "রেলষ্টেশন"৷
(অথচ বাংলা একাডেমির নিয়ম হলো, বিদেশি শব্দে ‘শ’ বা ‘স’ বসে। চ-বর্গীয় শব্দে ‘শ’ বসে। ট-বর্গীয় (ট, ঠ, ড) বিদেশি শব্দে স বসে। যেমন: তামাশা, খুশি, মসজিদ, সালাম, আশ্চর্য, নিশ্চয়, পশ্চিম, আগস্ট, মাস্টার, স্টোর, পোস্টার, স্কুল।
ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা কেবল ভাষার প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করি। বাকি এগারোটি মাস ভাষাচর্চায় আমাদের উদাস ও লাগামহীন হয়ে পড়ি।
ভাষার এই মাসের প্রতি ফ্যাশনেবল ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে ‘অ, আ, ক, খ, ঙ,’ খচিত পোশাক পরিধান করি। মোবাইলে ভাষা বিষয়ক ওয়েলকাম টিউন ও রিংটোন লাগাই। সুযোগ পেলে বক্তৃতা-সেমিনার করে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করি। আর যুগ-যুগ ধরে নিজেরাই বাংলা বানান, উচ্চারণ, শব্দ চয়ন, প্রক্ষেপণ ও প্রয়োগ ভুল করি।
কিছু উদাহরণ দেখি৷ সাধারণের চলাচলের পথের ধারে কিছু বানান প্রমাদ আমাদের অহরহ চোখে পড়ে। এসবের মধ্যে ধরা যাক- যদি একটি গাড়ি হয় বিদ্যুৎ বিভাগের বা বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের তবে সেই গাড়িতে লেখা থাকবে ‘জরুরী বিদ্যুৎ সরবরাহ’, ওষুধ কোম্পানির গাড়ি হলেও অনুরূপ ভুল বানানে লেখা থাকবে ‘জরুরী ঔষধ সরবরাহ’, কিংবা ‘জরুরী রপ্তানী কাজে নিয়োজিত’ ইত্যাদি। ভাবখানা এমন যে, ‘ঈ-কার’ ব্যবহারপূর্বক সরকারী, জরুরী, কোম্পানী, রপ্তানী, ফার্মেসী, তৈরী, বেশী, কাশী, গরীব, চাকরী, পদবী, ইত্যাদি লিখলে তা শক্তিশালী ও শুদ্ধ হয়। অনেকে তো একুশে ফেব্রুয়ারি কে " ফেব্রুয়ারী" লেখেন৷
(অথচ বাংলা একাডেমির নিযম সকল প্রাদেশিক ও বিদেশি শব্দে ঈ-কার না বসে ই-কার বসে। যেমন: শুমারি, আমদানি, খানদানি, খুশকি, খুশি, বন্দি, জংগি, জমি, জরি, জামদানি, জিনজির, জিন্দাবাদ, জিন্দেগি, দরজি, দাগি, বিরিয়ানি, মুরগি, আবির, আমিন, আসামি, গরিব, কেরানি, দাদি, নানি, চাচি, ফুপি, মাসি, ভাবি, কাহিনি, কোম্পানি, জানুয়ারি, সেনচুরি, চৌধুরি, লুংগি।)
শতাব্দীর বিরলপ্রজ ইসলামী গবেষক ও বরেণ্য স্কলার আল্লামা সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সফরকালে কওমি আলেমদের সমাবেশে যে কথা বলেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য, ‘বাংলা ভাষার সাধারণ চর্চা এখন আর যথেষ্ট নয়। এ কাজ সবাই করবেন। এখন কিছু মানুষকে বাংলা ভাষার কর্তৃত্ব হাতে নেয়ার জন্য প্রাণপণ সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। এটা আলেমদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জরুরি, তেমনি বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান ও খোদ বাংলা ভাষার জন্যও অপরিহার্য। বাংলা ভাষার শোধন, সংস্কার ও সমৃদ্ধির জন্য এ কাজ খুবই জরুরি। কেননা দীর্ঘ দিন ধরে বাংলা ভাষার কর্তৃত্ব ইসলামবিরোধী গোষ্ঠীর হাতে; যাদের চিন্তা ও চেতনা এবং জীবন ও চরিত্র কলুষমুক্ত নয়; বরং তারা আকিদা ও চিন্তাগত ভ্রান্তিতে আক্রান্ত। তাদের মাধ্যমে এ ভাষাতেও প্রবেশ করেছে কলুষ ও চিন্তার বিষবাষ্প। এ জন্য বাংলা ভাষায় রূহ ও রূহানিয়াত এবং প্রাণ ও প্রাণময়তা সৃষ্টি ও সঠিক পরিচর্যার জন্য এমন কিছু মানুষকে প্রাণপণ সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে হবে, যারা সমুন্নত চিন্তাচেতনা এবং পবিত্র রুচি ও আদর্শের অধিকারী। "বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় কোনো পুণ্য নেই, যত পুণ্য সব আরবি আর উর্দুতে", এ ধারণা বর্জন করুন। এ ধারণা নিছক মূর্খতা। তিনি আরো বলেছিলেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ইসলাম বিরোধীদের দয়া-করুণার ওপর ছেড়ে দেবেন না। ‘ওরা লিখবে আর আপনারা পড়বেন’- এ অবস্থা কিছুতেই বরদাশত করা উচিত নয়’ (১৯৮৪ সালের ১৪ মার্চ জামিয়া ইমদাদিয়া, কিশোরগঞ্জ-এর প্রাঙ্গণে বিশিষ্ট আলেম-উলামা, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র-শিক্ষক সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণ)।
এবারের ফেব্রুয়ারি আমাদের অন্তত এভাবে প্রাণিত করুক যে, আমরা সচেতনভাবে বাংলা বানান ও বাক্য গঠনের ব্যক্তিক আন্দোলনের তরঙ্গে নিজেদের শাণিত করব। পৃথিবীর সব জাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরাও এই তরঙ্গে আন্দোলিত হয়ে উঠুক- তারাও শুদ্ধভাবে স্ব-স্ব মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে তাদের তার শ্রীবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি সাধনে মগ্ন হবে। ভাষার শুদ্ধ চর্চায় শুধু নির্দিষ্ট একটি মাস নয়- সব সময়ের নিরন্তর প্রেরণা হোক ফেব্রুয়ারি-একুশে ফেব্রুয়ারি। তাহলেই রফিক জব্বার সালাম বরকতের আত্মোৎসর্গ সার্থক হবে।