করোনা ভাইরাস: মহামারীর উপকারিতা

 
করোনা ভাইরাস: মহামারীর উপকারিতা

মুফতি রেজাউল করিম:

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ্ব  আজ  নিথর নিস্তব্ধ ৷ সবাই সবার থেকে পলায়ন করছে ৷ ঠিক  হাশরের ময়দানের  মত ৷ 'সবাই সবার' জন্য এ কথাটি  আজ  মুখের বুলিমাত্র ৷  করোনা  ভাইরাস এ মহামারীতে  রয়েছে বিশ্ববাসীর জন্য  অনেক  উপকার ও ফায়দা ৷
আল্লাহ তায়ালা মানুষের পাপাচারের কারণে বিভিন্ন সময়ে মানুষকে পরীক্ষা করেন ৷ পরীক্ষা করেন বালা মুসিবত দিয়ে ৷ ইমতিহান নেন করোনার মত ক্ষুদ্র ভাইরাস এর মাধ্যমে ৷ এ পরীক্ষায় তারাই সফলতা অর্জন করেন যারা সবর করেন ৷ ধৈর্যের পরিচয় দেন ৷ কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী নিজের জীবন পরিচালিত করেন ৷ তাওবা করেন ৷ আল্লাহর দিকে ফিরে আসেন ৷


আরো পডুন >> মহামারীতে মুমিনের করণীয়৷ মূল ইবনে হাজার আসক্বালানী

তবে এ পরীক্ষা সবার জন্য এক রকম নয় ৷ কারো জন্য শুধু পরীক্ষা ৷ আবার কারো জন্য গযব৷ হ্যা, কুরআন সুন্নাহ এটাই বলে ৷ এ পরীক্ষার মাধ্যমে কারো মর্যাদা বৃদ্ধি পায় ৷ কারো আবার হ্রাস ৷

মুমিনের জন্য করোনাভাইরাস,বালা মুসিবত, মহামারী সবই রহমতস্বরুপ ৷ কুরআন হাদীস এনালাইসিস করে এটাই বুঝা যায় ৷
হযরত আয়শা রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মহামারী সম্পর্কে জানতে চাইলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,
أنه عذاب يبعثه الله على من يشاء وأن الله جعله رحمة للمؤمنين ليس من أحد يقع الطاعون فيمكث في بلده صابرا محتسبا إلا كان له مثل أجر شهيد  


অর্থাৎ বালা মুসিবত হলো একটি আযাব ৷ যাকে ইচ্ছা  আল্লাহ তার  কাছে  প্রেরণ করেন ৷ মুমিনদের জন্য তা করেছেন রহমতস্বরুপ৷ যে ব্যক্তি মহামারীতে নিপতিত হয়ে সওয়াবের নিয়তে নিজ  শহরে অবস্থান করেন ৷ তার জন্য রয়েছে শহীদের প্রতিদান ৷

কোনো মুসলিম ব্যক্তি যখন কোনো মহামারীতে আক্রান্ত হয় তখন মানুষ মনে করে, লোকটি মনে হয় বদকার ৷ এ মহামারী তার জন্য শাস্তি স্বরুপ ৷ এটা তার ওপর আল্লাহর গজব অভিসাপ ৷ অতপর যখন সে ইন্তেকাল করে তখন লোকে ভাবে,সে জাহান্নামের  উপযুক্ত ৷ তার জন্য রয়েছে  জাহান্নামের কঠিনতর আযাব ৷

কিন্তু হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী এ ধারনা সম্পূর্ণ ভুল ও গলত ৷ কারণ মহামারীতে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিকে পাপী-জাহান্নামি মনে করা যাবে না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহামারীতে মারা যাওয়া ব্যক্তিকেও শহীদ হিসেবে গণ্য করেছেন। হযরত আনাস ইবনে মালিক রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
الطاعون شهادة لكل مسلم
অর্থাৎ ‘মহামারীর কারণে মারা যাওয়া প্রতিটি মুসলিমের জন্য শাহাদাত।’            [বোখারি, হাদিস : ২৮৩০]
আরো পডুন>>হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া কি জায়েয হবে?


তবে এটা নিশ্চিত যে, মহামারী বিশ্বকে পরিবর্তন করে দিয়ে যায় ৷ পরিবর্তন করে দিয়ে যায় সমগ্র মানুষকে ৷ বিশাল একটা ফায়দা উপকার করে দিয়ে যায় ৷ জুলম অত্যচার প্রায় বন্ধ হয়ে যায় ৷ পতিতালয়গুলো বন্ধ হয়ে যায় ৷ চলে না তাদের রমরমা দেহ ব্যবসা ৷ মদ জুয়ার  দোকানগুলোও থাকে বন্ধ ৷ চুরি রাহজানিও  তেমন একটা হয় না ৷ অধিকাংশ  মানুষই  হয়ে যায় আল্লাহমুখি ৷ মসজিদমুখি ৷ করে তাওবা ও ইস্তেগফার ৷
শাইখ ইবনে হাজার আসক্বালানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ৷ সহীহ বুখারী ব্যাখ্যাগ্রহন্থ "ফাতহুল বারী"র রচয়ীতা ৷ তিনি স্বীয় " বাযলুল মাউন ফি ফাযলিত তাউন" কিতাবে মহামারীর চারটি উপকারীতার কথা আলোচনা করেছেন ৷  হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন,
মহামারীর উপকারিতা হলো,

১. ইহকালের লোভ, লালসা ও লিপ্সা কমে যাওয়া।
২. পরকালের আমল সুন্দর করার প্রতি ম‌নো‌যোগী হওয়া।
৩. অবহেলা ও অলসতা থেকে স‌রে আসা।
৪. মৃত্যুর প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
[বাযলুল মাউন : ৩৮৭ পৃষ্ঠা]

মহামারীর ১ নং উপকারিতা: আশা আকাঙখা সংক্ষিপ্ত করা ৷

এ পার্থিব জগতে, নশ্বর পৃথিবীতে কয়েকটা দিন থাকার জন্যে মানুষ কত বিশাল বিশাল স্বপ্ন দেখে ৷ মনে বড় বড় স্বপ্ন আঁকে ৷ গাড়ি করবে, বাড়ি করবে ৷ করবে মিল কারখানা আর গড়বে বড় বড় ফ্যাক্টরি ৷ আর এ স্বপ্ন পূরণের জন্যে আকাঙখা বাস্তবায়নের জন্যে অতিব মূল্যবান সময় ও শরীর নফস ও জান ব্যয় করে দেয় ৷

স্বপ্ন পূরণের মাঝপথে হঠাৎ যখন মহামারি চলে আসে ৷
তখন মহামারী এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের অন্তসারশূন্যতা চোখের সামনে মেলে ধরে। ফুটিয়ে তোলে এ পার্থিব জাহানের তুচ্ছতা ও অসাড়তার আসল চিত্র ৷

মহামারীর অনেক বড় একটি উপকার বা শিক্ষা হলো,আমাদের ভেতরের মনুষ্যত্যকে জাগিয়ে তোলে৷ নতুন করে ভাবতে শেখায়, চিন্তার খোরাক যোগায় ৷ মহামারি মনে করিয়ে দেয় এ দুনিয়া স্থায়ী আবাসস্থল নয় ৷ এটা স্থায়ীভাবে থাকার স্থান নয় ৷ এটা আসল বাড়ি নয় ৷ তুমি মনে মনে যে স্বপ্নের চিত্র অঙ্কন করেছ তা নকল স্বপ্ন ৷ আসল স্বপ্ন নয় ৷

মহামারী আমাদের সেই ভুলে যাওয়া পাঠ স্বরণ করিয়ে দেয় যে, এ তুচ্ছ দুনিয়ার জন্য বড় বড় প্লান পরিকল্পনা না করে আখিরাতের জন্য প্লান কর ৷ যেখানে অনন্ত অবিরতকাল  থাকতে হবে ৷ সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী নিজের লাইফস্টাইলকে পরিচালিত কর ৷

আরো পডুন >>করোনা ভাইরাসের কারণে মাস্ক পরে নামায আদায় করা কি জায়েয হবে?


মহামারীর ২ নং উপকারিতা: স্বীয় আমলকে সুন্দর করা ৷

তুচ্ছ দুনিয়ার মোহে পরে মানুষ ছেড়ে দেয় সব নেক আমল ৷ ভুলে যায় নিজের পালনকর্তা রবকে ৷ অনুসারী-ফলোয়ার হয় মরদুদ- বিতাড়িত প্রকাশ্য শত্রু শয়তানের ৷ ছেড়ে দেয় সালাতসহ ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলী ৷ এমনকি অস্বীকার করে বসে কুরআন সুন্নাহর চিরন্তন সত্যকে ৷ অনেকেই আবার 'নাম কা ওয়াস্তে' ইসলাম পালন করলেও অন্তরে থাকে কপটতা- নিফাক ৷ আমলের মধ্যে থাকে না কোনো ইখলাস একনিষ্ঠতা ৷ উদ্দ্যেশ্য থাকে  রিয়া আর মানুষকে দেখানো ৷ ইবাদতগুলো হয় গাইরুল্লাহর জন্যে ৷

করোনা ভাইরাসসহ যে কোনো মহামারি মানুষকে আল্লাহর দিকে রুজু হতে ফিরে আসতে আহ্বান করে ৷ ব্যক্তিগত আমল থেকে নিয়ে শুরু করে পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপও একুরেট ইনসাফ ভিত্তিক করতে উৎসাহিত করে ৷ জুলম নির্যাতন, অন্যায় অবিচারের পথও বন্ধ করতে তাগিদ দেয় ৷ গাইরুল্লাহর ইবাদত পুজা ছেড়ে একমাত্র এক ইলাহের ইবাদতের কথা মনে করিয়ে দেয় ৷ ইবাদতের মধ্যে খুলুসিয়ত সৃষ্টি হয় ৷ বেড়ে যায় কালামে পাকের তেলাওয়াত ৷ সকাল সন্ধ্যায় বেড়ে যায় মাসনুন আমলসমূহ ৷ যা আগে ছিলো অকল্পনীয় ৷ বেড়ে যায় দান সদকা ৷ সবাই খোঁজ নেয় আত্বীয় স্বজনের ৷

বন্ধ হয়ে যায় অধিকাংশ পাপের উর্বর ভূমি ৷ বন্ধ করে দেওয়া হয় সিনেমা হল ৷ খদ্দের পায় না পতিতালয়গুলো ৷ বন্ধ হয়ে যায় মদের বড় বড় বারগুলো ৷ পাপি তাপি সবার ভিতরে সুন্দর দিকটা জেগে ওঠে ৷ তাওবা করে সবাই হয়ে যায় পিওর একনিষ্ঠ আল্লাহর বান্দা ৷

আরো পডুন >> করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে মুফতি রেজাউল করিমের পরামর্শ

মহামারির ৩ নং উপকারিতা:   উদাসীনতা থেকে মুক্ত হওয়া।

অধিকাংশ  মানুষ দ্বীনি বিষয়ে থাকে উদাসীন ৷ ইবাদত বন্দেগিতে করে অলসতা ৷ অনিহা প্রকাশ করে সালাত কায়েমের কথা বলা হলে ৷ এড়িয়ে যায় বিভিন্ন ওযুহাতে ৷ পলায়ন করে ধর্মীয় অধিকাশ ইস্যু থেকে ৷ নিমজ্জিত থাকে অথৈ পাপ সাগরে ৷
অলসতা উদ্যমহীনতা উদাসীনতা এমন এক ব্যাধী যা মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা থেক দূরে ঠেলে দেয় ৷ ফলে সে হয় একজন ব্যর্থ মানুষ ৷ আমি আপনি আমরা সবাই অলসতাকে অপছন্দ করি ৷ ঘৃণা করি ৷ অলস মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করার আপ্রাণ চেষ্টা করি ৷ সিমাক আলহানাফি রহ. বলেন,

    سَمِعْتُ ابْنَ عَبَّاسٍ يَكْرَهُ أَنْ يَقُولَ : إنِّي كَسْلاَنُ
অর্থাৎ "আমি ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সম্পর্কে শুনেছি, তিনি কাউকে "আমি অলস" একথা বলতে পছন্দ করতেন না। [মুসান্নাফ ইবনি আবী শাইবা ৯/৬৭]

হাফেজ ইবনু হাজার আসকালানি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
ويتولد من طول الأمل الكسل عن الطاعة والتسويف بالتوبة

অর্থাৎ "দীর্ঘ আশা ইবাদতে অলসতা তৈরি ও তাওবার ক্ষেত্রে গড়িমসি তৈরি করে।"
[ফাতহুল বারী ১১/২৩৭]

অতপর যখন মানুষ কোনো মহামারি মুসিবতে পতিত হয় ৷ বিদায়  নেয় তার অলসতা ৷ দুৱীভূত হয় তার উদাসীনতা ৷ চলে যায় উদ্যমহীনতা ৷ সে হয়ে যায় একজন একটিভ মানুষ ৷ হয়ে ওঠে ইবাদাতে কর্মঠ তৎপর ৷ নতুন করে জেগে ওঠে কর্মতৎপরতা ৷ থাকে না আর আলসেমিভাব ৷ এ সবই হয় মহামারির বদৌলতে ৷ এটাই মহামারির উপকারিতা ৷

আরো পডুন >>করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে আল্লামাহ আহমদ শফীর পাঁচটি পরামর্শ

মহামারির ৪ নং উপকারিতা: আখেরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

হিউম্যান লাইফ তথা মানব  জীবনের দুটি স্তর ৷ একটি  ইহলৌকিক অপরটি পরলৌকিক ৷ দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী ৷ আখিরাতের জীবন অনন্তকালব্যপী ৷  আমরা আমোদ-আহ্লাদ, ভোগ-বিলাস, সুখ-শান্তিতে আত্মহারা হয়ে এই দুনিয়ায় থাকছি, খাচ্ছি; সবকিছু মনের মতো উপভোগ করছি। সে তুলনায় মূল যে জায়গায় অনন্তকাল ধরে থাকতে হবে- আখেরাত জীবন; তার কথা কে কতটা ভাবছি? দুনিয়ার লোভে, পার্থিব সম্পদের লালসায় ভুলে যাই আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে ৷ সম্পদের পাহাড় গড়ে দুনিয়ার বিলাসিতায় মত্ত থেকে মনে করি এটাই আমার স্থায়ী ঠিকানা ৷
[ তরুণ লেখক ও কলামিস্ট মুফতি রেজাউল করিম, সুফফাহ মাদরাসা, মহেশপুর, ঝিনাইদহ]

আরো পডুন >>নানার আগে মা মারা গেলে নাতিরা কি মিরাস পাবে?

 







সত্য প্রকাশ

আমার নামঃ মুফতি রেজাউল করিম। আমি একটি কওমী মাদরাসায় শিক্ষকতা করছি। পাশাপাশি এ ব্লগের সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। অনলাইন সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান থাকায় সময় পেলে দ্বীন ইসলাম নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করি। যেন অনলাইনেও মানুষ ইসলামি জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আপনিও চাইলে এ ব্লগে লিখতে পারেন।

Please Select Embedded Mode For Blogger Comments

নবীনতর পূর্বতন